কাজ শেষ হলে দেশের মানুষ সুফল পাবে,
করোনা মহামারি ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে দেশের ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত আট মেগা প্রকল্পের কাজ। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন। কাজ এগিয়ে নিতে সবসময় নজর রাখছে সরকার। চলতি অর্থবছরের বাজেটেও মেগা প্রকল্পগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপ) বেশিরভাগ অর্থই থাকছে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আট মেগা প্রকল্পে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত গড় ভৌত অগ্রগতি ৮১ দশমিক ৪৫ শতাংশ। গড় আর্থিক অগ্রগতি ৬৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
আট মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮ হাজার ৬৮১ কোটি ৫ লাখ টাকা। গত মে মাস পর্যন্ত এসব প্রকল্পে খরচ হয়েছে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৪৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি খরচ করা হয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে। এই প্রকল্পে মে মাস পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৫৯ হাজার ৯৪৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পগুলোর মে মাসের অগ্রগতি প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরকার ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত বা অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে। এসব প্রকল্পের মেয়াদ বাড়লে খরচ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত প্রকল্পগুলোর সঙ্গে বিদেশি ঋণ ও বিদেশ থেকে মালপত্র কেনাকাটার বিষয় রয়েছে। সরকার ঋণগুলো সময়মতো কাজে লাগাতে চায়।
বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, এসব প্রকল্পে সরকারের বিশেষ নজর রয়েছে। অগ্রগতি গভীরভাবে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। নিয়মিত পরিদর্শন করা হচ্ছে। যাতে বাস্তবায়নে কোনো রকম বাধাগ্রস্ত না হয় এবং দ্রুততম সময়ে শেষ হয়।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সরকার বড় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দৃশ্যমান করতে চাচ্ছে। কারণ, এটি করতে পারলে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় কাজে লাগে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সরকার মেগা প্রকল্পগুলো দ্রুত শেষ করতে চাইছে, এটি অবশ্যই ভালো। কাজ শেষ হলে দেশের মানুষ সুফল পাবে, অর্থনীতিতেও অবদান শুরু হবে। যেগুলো প্রায় শেষ হওয়ার পথে সেগুলোতে অতিরিক্ত ব্যয় করে শেষ করে ফেলাই ভালো।
ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত প্রকল্পগুলো হলো—পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, দোহাজারী-রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু-মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্প। এসব প্রকল্পের কয়েকটি এরই মধ্যে উদ্বোধন হয়েছে। আরও কয়েকটি উদ্বোধনের অপেক্ষায়।
পদ্মা সেতু: বড় মেগা প্রকল্পের মধ্যে অন্যতম পদ্মা সেতু। দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের মানুষের স্বপ্নের এই পদ্মা সেতু গত বছরই উদ্বোধন করা হয়েছে। সুফল পেতে শুরু করেছে দেশের মানুষ। যদিও এটির কাজ শতভাগ শেষ হয়নি। উদ্বোধন ও যান চলাচল শুরুর এক বছর পর এই সেতুর ব্যয় ১ হাজার ১১৭ কোটি ৯৭ লাখ ৯০ হাজার ৫৮০ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সর্বশেষ সংশোধন অনুযায়ী, সেতুটির নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৩২ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। গত মে পর্যন্ত খরচ হয়েছে ২৮ হাজার ৭৬৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৯৮ শতাংশ। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে প্রকল্পটির মেয়াদ।
মেট্রোরেল: রাজধানীবাসীর বহুল প্রত্যাশিত মেট্রোরেল প্রকল্পের উত্তরা-আগারগাঁও অংশ গত বছর ২৮ ডিসেম্বর উদ্বোধন হয়েছে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ মতিঝিল পর্যন্ত দ্বিতীয় অংশ খুলে দেওয়া হতে পারে। পুরো প্রকল্প শেষ হতে অপেক্ষা করতে হবে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। মে পর্যন্ত এই প্রকল্পটিতে খরচ হয়েছে ২১ হাজার ৮৮৪ কোটি ৯ লাখ টাকা। ভৌত অগ্রগতি ৭৭ শতাংশ। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সংশোধিত ব্যয়সহ মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। ২০১২ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্প ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র: দেশের ইতিহাসে একক হিসেবে সবচেয়ে বেশি টাকা বরাদ্দ পাওয়া প্রকল্প হলো রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ঋণ পরিশোধের জটিলতায় এই প্রকল্পের সামগ্রিক অগ্রগতি তুলনামূলক কম হয়েছে। প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ না হলেও আগামী সেপ্টেম্বরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানা গেছে। ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১৬ সাল থেকে ২০২৫ সাল মেয়াদে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়। শুরু থেকে মে পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৫৯ হাজার ৯৪৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। ভৌত অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৫৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ: পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পে চলতি বছরের মে পর্যন্ত খরচ হয়েছে ২৮ হাজার ৫১২ কোটি ৮ লাখ টাকা। ভৌত অগ্রগতি ৭৭ শতাংশ। এটি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পটি শেষ করার লক্ষ্য আগামী বছরের জুনের মধ্যে।
মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র: দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রকল্প মহেশখালী-মাতারবাড়ী সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন কার্যক্রম। এ প্রকল্পের অধীনে মাতারবাড়ী ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ ১২টি প্রকল্প কাজ চলছে। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ৫১ হাজার ৮৫৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। ২০১৪ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পটি প্রথম সংশোধনীর পর ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা রয়েছে। মে পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩২ হাজার ৬৬১ কোটি ১৯ লাখ টাকা। ভৌত অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৭৬ দশমিক ৩০ শতাংশ।
মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রজেক্ট: রামপালে হচ্ছে ১৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রজেক্ট (রামপাল) বিদ্যুৎকেন্দ্র। ২০০৯ সালের জুলাই থেকে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। গত মে মাস পর্যন্ত খরচ হয়েছে ১৩ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৯২ দশমিক ৯০ শতাংশ।
পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর: ৪ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর। প্রকল্পটি ২০১৫ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়। ২০২৩ সালের জুনে কাজ শেষ হওয়ার কথা। এখন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৬২৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। ভৌত অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৮৯ দশমিক ৮৪ শতাংশে।
দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেলপথ নির্মাণ: ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে দোহাজারী-রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু-মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। চলতি বছরের মে পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৮৫ শতাংশ।