বিশেষ প্রতিবেদক
ইলিশ, এনা আর বিএমএফ পাশাপাশি তিনটি গাড়ির প্রতিযোগিতা। অন্যদিকে লোকাল গাড়ির আড়াআড়ি ক্রসিং, সড়কের পাশেই দূরপাল্লার বাসের কাউন্টার। বিআরটিসি কাউন্টারের বিপরীতে রাস্তার পূর্বপাশটা বন্ধ ময়লা আবর্জনার স্তূপ ও নোংরা পানিতে। আর সড়কের দুইপাশে সিএনজি অটোরিকশা, ইজিবাইক ও মহেন্দ্র পার্কিং এর কারণে লাগাতার যানজটের অতিষ্ঠ এখানের জনজীবনে। গত তিনদিন ধরে সকালে প্রায় দু-তিন ঘণ্টা বন্ধ হয়ে থাকে বরিশালের নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনালসহ আশেপাশের এলাকার যান চলাচল। তিনজন ট্রাফিক সার্জেন্টসহ নয়জন পুলিশ সদস্য ও হাইওয়ে পুলিশের একটি দল ছুটোছুটি করছেন যানজট নিয়ন্ত্রণ করতে। তারা গাড়ি চালকদের বার বার অনুরোধ করছেন দ্রুত গাড়িগুলো সরাতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? পুরো সড়কে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করে নির্দ্বিধায় দাঁড়িয়ে আছে বাস, সিএনজি, মহেন্দ্র ইজিবাইক ও অটোরিকশা। সড়কের একাংশে আবার চলছে ফোরলেন তৈরির জন্য কাটাকাটি।
গত শনিবার থেকে শুরু হয়েছে এই ফোরলেন কাজ। ফলে এখানের সড়কে সকাল আটটা থেকে বেলা বারোটা পর্যন্ত তীব্র যানজটে আটকে থাকে বরিশালের সকল অগ্রগতি। ১১ জুলাই মঙ্গলবার সকালেও দেখা গেছে একইচিত্র।
নগরবাসী সাধারণ মানুষ ও পথচারীদের অভিযোগ, নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনালের চালকদের সেচ্ছাচারীতা এবং অবৈধ থ্রি হুইলার, বিশেষ করে সিএনজি, অটোরিকশার কারণেই বরিশালে যানজট এখন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে।
সরেজমিনে মঙ্গলবার সকালে বরিশালের নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে উত্তরে কাশিপুরে, দক্ষিণে সিএন্ডবি সড়ক হয়ে সাগরদি, রূপাতলী গোলচক্কর পর্যন্ত এবং নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনালের বিপরীতে কলেজ রোড থেকে নতুনবাজার এলাকায় দীর্ঘ যানজট তৈরি হতে দেখা গেছে। ১০/১২ জন ট্রাফিক পুলিশ সদস্য এটা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছেন। সড়কের পুরোটা দূরপাল্লার বাস চালকদের নিয়ন্ত্রণে। আর সড়কের দু’পাশ দখল করে আছে অগণিত সিএনজি, অটোরিকশা, ইজিবাইক আর মহেন্দ্র। যে যেভাবে খুশি গাড়ি ঘোরাচ্ছে ট্রাফিক পয়েন্টকে ঘীরে সড়কের উপরেই। প্রায় পনের বিশ-মিনিট নিরুপায় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন পুলিশ সদস্যরাও। পরে হাইওয়ে পুলিশের সহযোগিতায় যানজট নিয়ন্ত্রণে অগ্রসর হয় মেট্রো ট্রাফিক। এখানেও তাদের সাথে এনা ও বিএমএফ পরিবহন চালকদের অযথা তর্ক করতে দেখা গেছে। সড়কের দুপাশে বিভিন্ন দূরপাল্লার পরিবহনের কাউন্টার তৈরি হওয়ায় সমস্যা আরো বেড়েছে। টার্মিনাল থেকে বের হয়েই কাউন্টারের সামনে ভিড় করছে বাসগুলো।
আরেকাংশে সিএনজি অটোরিকশা ও ইজিবাইক শ্রমিকরা ঘাঁটি গেড়ে বসে আসে রাস্তার মোড়ে মোড়ে। একদলকে তাড়ালে, আরেকদল এসে ফাঁকা স্থান দখল করছে। এ যেন শূন্যস্থান ভরটের প্রতিযোগিতা চলছে পুরো মহাসড়ক জুড়ে।
সিএনজি ও অটোরিকশা বন্ধ করে দেয়ার দাবী তুলে বরিশালের নগর চিন্তাবিদদের একজন কাজী মিজানুর রহমান বলেন, গত প্রায় একসপ্তাহ ধরে বরিশাল নগরীর যানজট অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশেষ করে সিএনজি ও অটোরিকশার সংখ্যা এতো বেড়েছে যে শহরের ভিতর পায়ে হাঁটাও কষ্টকর এখন। তিনি বলেন, পরিকল্পিত নগরায়নের প্রথম ও প্রধান শর্তই হচ্ছে নগরীর ভিতর কোনো বাস টার্মিনাল থাকতে পারবে না। আর মহাসড়কে থ্রী হুইলার নিষিদ্ধ হতে হবে এবং অবৈধ যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে হবে।
ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও সিএনজিকে নিরব ঘাতক উল্লেখ করে বাংলাবাজার এলাকার বাসিন্দা বিউটি আকতার বলেন, এই অটোরিকশা আর সিএনজিগুলো হুটহাট ছুটে আসে, ওদের আসার কোনো শব্দও পাওয়া যায়না। আমার স্বামীকে আঘাত করে ফেলে দিয়ে গেছে। আজ চারদিন সে পায়ে আঘাত পেয়ে ঘরে বসে আছেন। এগুলো দ্রুত বন্ধ করে দেওয়া উচিত বলে জানান তিনি।
এদিকে রূপাতলী বাসস্ট্যান্ডের আশেপাশে সিএনজি ও ইজিবাইক স্ট্যান্ডের কারণেও তৈরি হচ্ছে বিশাল যানজট। যদিও ইজিবাইক ও মহেন্দ্র চালকদের দাবী, এখানে যানজটের অন্যতম কারণ ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা। বাসগুলো এসে ইচ্ছেমতো যেখানে সেখানে যাত্রী ওঠানামা করায়। ফলে এখানে যানজট তৈরি হয় বলে দাবী তাদের।
যদিও কথার তীব্র বিরোধিতা করে দায়িত্বরত ট্রাফিক কনস্টেবল বলেন, একটু দাঁড়িয়ে নিজেই অবস্থাটা দেখতে পারবেন। ইজিবাইক, সিএনজি, অটোরিকশা আর মহেন্দ্র কতগুলোকে তাড়াবো, একদিকে তাড়াই, আরেকদিকে এসে জড়ো হয়। আর বাসগুলো লোকাল বাস টাইম মেনে চললেও দূরপাল্লার বাসগুলো কথা শোনেনা বলে জানান তিনি।
রূপাতলী বাসস্ট্যান্ডের ১১১টি গাড়ি চলছে গত বিশ বছর ধরে দাবী করে বাস শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি সুলতান মাহমুদ বলেন, নগরীতে সিএনজি অটোরিকশা যত বেড়েছে ততটা বাসের সংখ্যা বাড়েনি। প্রতিটি গাড়ি ৩ মিনিট করে সময় নির্ধারণ করা আছে, তাই রূপাতলী বাস টার্মিনালের কারণে মহাসড়কে কোন যানজট হয় না।
২৫ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও রূপাতলী বাস শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি সুলতান মাহমুদ আরো বলেন, পদ্মা সেতু চালু হবার পর থেকে ক্রমাগত ঢাকা বরিশাল, কুয়াকাটা ও পিরোজপুর মহাসড়কে চাপ বেড়েই চলছে। সড়ক প্রশস্তকরণ কাজ চললেও যানজট নিরসনের জন্য নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনালটি গড়িয়ারপাড় এবং রূপাতলী বাস টার্মিনালটি কালিজিরা পয়েন্টে কোথাও স্থানান্তরিত করা খুবই জরুরী। একইসাথে একজন কাউন্সিলর হিসেবে জনগণের সুবিধা বিবেচনা করে রূপাতলী গোলচক্করের পরিধি আরো বৃদ্ধির প্রস্তাব করেন কাউন্সিলর সুলতান মাহমুদ। তিনি বলেন, এই গোলচক্করে সিএনজি – মহেন্দ্র ও ইজিবাইকের স্ট্যান্ড সরাতে হবে। নগরীতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত এসব যানবাহন চলাচল করছে। অবৈধভাবে চলাচলকারী এসব যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং আর যাতে একটি গাড়িও না বাড়ে সে বিষয়টি অনুমোদনকারী কমিটি আরটিসিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
এদিকে রবিবার সকাল থেকে নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনালের যানজট নিরসনের কাজ করছেন দাবী করে
নথুল্লাবাদ বাস মালিক গ্রুপের সভাপতি মোঃ আফতাব হোসেন বলেন, আজ সকালেও কিছু গাড়িকে নোটিশ করা হয়েছে। টার্মিনালের বাইরে যত্রতত্র পার্কিং বন্ধের চেষ্টা চলছে আগামী দুই দিনের মধ্যে এগুলো ঠিক করা হবে।
তিনি নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনালের পরিধি আরো বৃদ্ধি ও সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছেন জানিয়ে বলেন, বাস টার্মিনাল স্থানান্তর সময়ের ব্যাপার। আগে যেখানে স্থানান্তরের প্রস্তাব করা হয়েছে সেটা ট্রাক টার্মিনালের জায়গা। তাই আপাততঃ এটাকেই সংস্কার করা হলে এখানেই ২০০ গাড়ি রাখা সম্ভব হবে। এ অবসরে জায়গা দেখে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ তা স্থানান্তরের ব্যবস্থা নেবে বলে জানান আফতাব হোসেন। বাস টার্মিনালের দু’দিকেই প্রবেশ পথ বন্ধ করে যত্রতত্র পার্কিং সম্পর্কে তিনি বলেন, এগুলো সব ঠিক হয়ে যাবে। সংস্কারের অভাবে অভ্যন্তরীণ সড়ক অব্যবহৃত হয়ে এটা ঘটছে।
৯০ ভাগ মানুষই যদি আইন না মানে, তাহলে ১০ ভাগ মানুষের জন্য আইন হতে পারে না উল্লেখ করে বরিশালের ট্রাফিক বিভাগের উপ পুলিশ কমিশনার (ডিসি ট্রাফিক) তানভীর আরাফাত নিজের অসহায়ত্ব তুলে ধরে বললেন, নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল স্থানান্তরিত না হলে মহাসড়কের যানজট নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব। তিনি বলেন, তিনজন ট্রাফিক সার্জেন্ট ও ছয়জন কনস্টেবল ওখানে এই মুহূর্তে দায়িত্ব পালন করছেন। ফোরলেন সড়কের খনন কাজ শুরু হওয়ায় এই মুহূর্তে যানজট আরো বেড়েছে। তবে তারচেয়েও বেড়েছে কিছু বাস চালক ও শ্রমিকদের স্বেচ্ছাচারিতা।
উপ পুলিশ কমিশনার আরো বলেন, এই পরিবহন নেতাদের ক্ষমতা এতোটাই বেশি যে চোখের সামনে তাদের অনিয়ম দেখেও কিছু বলতে পারেন না সার্জেন্ট। বললেই তারা দলবেঁধে মারমুখো আচরণ করে। দ্রুত এই বাস টার্মিনাল গড়িয়ারপাড় এলাকায় স্থানান্তর করার আহ্বান জানান তানভীর আরাফাত।