জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগ আগস্ট মাসব্যাপী কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। ১২ দিনের কর্মসূচীর একটিতে স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে ২শ বছরের পুরোনো উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহি বরিশাল বিভাগে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সব থেকে বড় উপসনালয় শ্রী শ্রী শংকর মঠ। যে স্থানটির সাথে জড়িয়ে রয়েছে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস, মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তসহ বহু জ্ঞানী গুনী সংগ্রামী মানুষ। ১২ দিনে শোক দিবস উপলক্ষে মহানগর আওয়ামী লীগের কর্মসূচী ১১ দিনে নানা স্থানে দিলেও ২০ আগস্টের কর্মসূচী দেয়া হয়েছে শ্রী শ্রী শংকর মঠ মন্দিরে। এতে করে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সনাতনধর্মাবলম্বীরা। তারা জানিয়েছেন নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে এমন স্থানে কর্মসূচী করা হচ্ছে। তাছাড়া মন্দিরে শোক দিবসের দিন বড় আয়োজন করে প্রার্থনা করা হয়, সেখানে রাজনৈতিক কর্মসূচী উদ্বেগজনক।
জানা গেছে, ১১ জুলাই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বরিশাল মহানগর এর পক্ষ থেকে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে- ৪ আগস্ট থেকে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত বরিশাল নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক হেমায়েত উদ্দিন সেরনিয়াবাত এর স্বাক্ষরিত এক চিঠির মাধ্যমে সেটি প্রকাশ করা হয়েছে। কর্মসূচীতে ১৯ ও ২০ নম্বর ওয়ার্ডের যৌথ অনুষ্ঠান করা হচ্ছে মন্দিরে।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদের বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সুরঞ্জিৎ দত্ত লিটু বলেন, সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় হলো ১২ দিনের এই কর্মসূচীর মধ্যে কোথাও কোন মসজিদ/মাদ্রাসাকে স্থান হিসেবে নির্ধারন করা হয়নি। যদিও এ ধরনের রাজনৈতিক অনুষ্ঠানগুলোতে সেটা না করাই বরংচ অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত আর প্রাসঙ্গিক। কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গাতে! আগামী ২০ আগস্টের যে কর্মসূচি নেয়া হয়েছে তাঁর স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ২০০ বছরের প্রাচীন শ্রীশ্রী শংকর মঠকে ! কেন এই স্থান নির্বাচন?
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটা একটা কলংকজনক অধ্যায়। তাই জাতীয়ভাবে দিনটিকে শোকদিবস হিসেবে পালন করে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনও। এমনকি বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের স্ব-স্ব ধর্ম প্রতিষ্ঠানে নিজেদের ধর্মীয় রীতি মেনেও দিনটিকে উদ্যাপন করেন। কিন্তু কেন একটি রাজনৈতিক দলের আয়োজন এরকম একটি প্রাচীন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে? প্রশ্নটি আমার নয়! এ প্রশ্নটি বরিশালের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠির।
লিটু বলেন, সনাতন ধর্মালম্বীদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে কেন রাজনৈতিক কর্মসূচী দেয়া হলো? বঙ্গবন্ধুর আত্মার শান্তি কামনায় প্রতি মন্দিরে প্রার্থনা করা হয়। এখানে রাজনৈতিক কর্মসূচী দেয়াটা উদ্বেগজনক।
বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদের বরিশাল জেলার সাধারণ সম্পাদক এড. হিরন কুমার দাস মিঠু বলেন- আমরা জানি জাতীয় নির্বাচন সন্নিকটে, আর নির্বাচনোত্তর সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার সবসময়ই হন এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষগুলো। যেখানে ১৯ ও ২০ নং ওয়ার্ডে সরকারি বরিশাল কলেজ, সরস্বতী স্কুল, ব্রজমোহন কলেজ সহ এত এত পরিমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর খোলা মাঠ রয়েছে; সেখানে শংকর মঠকে ২০ আগস্টের অনুষ্ঠানের স্থান হিসেবে নির্বাচন এই অঞ্চলের মানুষগুলোকে অনাগত ভবিষ্যতে একটি বিপদের দিকে ঠেলে দেয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত প্রদান করে।
বরিশাল মহানগর যুব ঐক্য পরিষদের আহবায়ক রনজিৎ সেনগুপ্ত বলেন, জাতীয় শোক দিবস এর এই কর্মসূচি ও বঙ্গবন্ধুকে বিতর্কিত করতে যে বা যারা এই কাজটি করেছেন তারা অতিসত্ত্বর এই স্থানটি পরিবর্তন করে নিজেদের বিতর্কের বাইরে নিয়ে আসার আহবান করছি। আমরা প্রশাসনের কাছেও আইনগত সহযোগিতা কামনা করছি।
সংগঠনটির সদস্য সচিব শুভ সাহা বলেন, মন্দির প্রাঙ্গনে এমন আয়োজন করে নির্বাচনের আগে অস্থিরতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে কিছু লোকজন। মন্দির প্রাঙ্গনে তারা তো সমাবেশের মত কিছু একটা করবে। সাধারণ সেন্সে কি এমন কিছু মন্দিরে করা যায় ? মন্দির প্রাঙ্গনে তাদের অনুষ্ঠানে কোরআন তেলোয়াতও হবে। যদি বলি সাম্প্রদায়িক উস্কানী দেয়া হবে এই অনুষ্ঠান থেকে তাহলে কি ভুল বলা হবে। জাতির পিতাকে যারা বিতর্কিত করতে চায় তারা জাতির শত্রু। আওয়ামী লীগ কিন্তু খন্দকার মোশতাকও করতো। তাই অহেতুক উদ্বেগ পরিস্থিতি সৃষ্টি না করার জন্য আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকের প্রতি আহবান রইলো।
শংকর মঠ মন্দিরে রয়েছে শিব মন্দির, কালী মন্দির, দুর্গা মন্দির, মনসা মন্দির, জগৎগুরু শংকরাচার্যের বিগ্রহ ও শংকর মঠ প্রতিষ্ঠাতা শ্রীমৎ স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতীর বিগ্রহ।
এদিকে প্রথমবারের মত শ্রী শ্রী শংকর মঠ মন্দিরে রাজনৈতিক কর্মসূচীর আয়োজন করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে মত ব্যক্ত করেছেন বরিশাল জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি এড. মানবেন্দ্র বটব্যাল, মহানগরের সাধারণ সম্পাদক জয়ন্ত লাল দাস, বরিশাল জেলা যুব ঐক্য পরিষদের সভাপতি অসিত রায়, সাধারণ সম্পাদক প্রিয়ংকর পাল, জেলা মহিলা ঐক্য পরিষদের সভাপতি অধ্যাপিকা সুরুচী কর্মকার, সাধারণ সম্পাদিকা অপর্না খা, মহানগরের সভাপতি দিপালী বাইন, সাধারণ সম্পাদক এড. সোনালী চক্রবর্তী, জেলা ছাত্র ঐক্য পরিষদের সভাপতি সঞ্জয় পাল, সম্পাদক দেবজ্যোতি আচার্য, মহানগরের সভাপতি অভয় সাহা ও সাধারণ সম্পাদক অনিম বসু।
এই বিষয়ে শ্রী শ্রী শংকর মঠ পরিচালনার দায়িত্বে থাকা শ্রীমৎ স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতী ট্রাস্টের দায়িত্বরতা মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।