১৯শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ রাত ১২:৩১

অরক্ষিত বরিশালের সব পর্যটন স্পষ্ট: কুয়াকাটায় প্রয়োজন নারী টুরিস্ট পুলিশ

আরিফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিবেদক
  • আপডেট সময়ঃ বৃহস্পতিবার, আগস্ট ৩১, ২০২৩,
  • 175 পঠিত

 

সাগরকন্যা খ্যাত কুয়াকাটা ছাড়া বৃহত্তর বরিশালের বেশিরভাগ পর্যটন স্পটগুলোই অরক্ষিত। বিভাগের ছয় জেলায় প্রায় দেড়শত পর্যটন স্পষ্ট থাকলেও হাতেগোনা তিন চারটি বড় স্পষ্টেই শুধু টুরিস্ট পুলিশের উপস্থিতি চোখে পড়ে। তবে সেখানেও নেই নারী পুলিশ। বেশিরভাগ পর্যটন স্পষ্টেই দর্শনার্থীদের জন্য কোনরকম নিরাপত্তা ও আশ্রয় কেন্দ্রের সুব্যবস্থা নেই বলে স্বীকার করেন জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনও। তবে টুরিস্ট পুলিশ কর্তৃপক্ষের দাবী, পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় সর্বত্র নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে না এটা সত্যি। তারপরও তারা স্বল্পসংখ্যক লোকবল নিয়েই ইতিমধ্যে জনপ্রিয় ও বিশ্বাসী বন্ধু হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে পেরেছেন।

২০১৫ সাল থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলাদেশের পর্যটন স্পষ্টগুলোর নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব টুরিস্ট পুলিশকে দেয়া হয়। সেই থেকে বরিশাল অঞ্চলে শুধুমাত্র কুয়াকাটা ঘীরে টুরিস্ট পুলিশের কিছুটা নিরাপত্তা বেষ্টনী ও প্রশংসনীয় কার্যক্রম চোখে পড়লেও তা প্রশ্নবিদ্ধ বলে জানান কলাপাড়া পৌরসভার মেয়র আনোয়ার হোসেন হাওলাদার। তিনি বলেন, এখানে টুরিস্ট পুলিশ প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করলেও তা যথেষ্ট নয়, তাদের করনীয় আরো অনেককিছু রয়েছে। কেননা কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে থানা ৭ কিলোমিটার দূরে। এখানে সাগর পাড়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট আছে। কাঁকড়া ও কাউয়াচরসহ তিনটি পয়েন্টে কম হলেও ৩০ জন টুরিস্ট পুলিশ প্রয়োজন। মেয়র বলেন, নারী পুলিশের সম্পৃক্ততা না থাকায় কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে অনেকবারই শিশু ও নারী পর্যটকদের সেবা দিতে হিমশিম ও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরেছে এখানের টুরিস্ট পুলিশ। তারউপর জনবল সংকটের কারণে কুয়াকাটার অনেকগুলো স্পটেই সন্ধ্যার পর তাদের টহল থাকেনা। সীবিচ ছাড়া বাকী সবগুলো স্পষ্টই তখন অরক্ষিত থাকে বলে জানান পৌর মেয়র।
এদিকে বরিশাল জেলার ১০ উপজেলাকে ঘীরেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেকগুলো পর্যটন স্পষ্ট। যার একটিতেও নেই কোনোরকম নাগরিক সুযোগ সুবিধা ও পর্যটকদের জন্য কোনো সুব্যবস্থা।
প্রাচ্যের ভেনিস খ্যাত বরিশালের আকাশ-বাতাস ও প্রকৃতিতে মিশে আছে নদ-নদী খালবিলের অপরূপ সৌন্দর্য্যের হাতছানি। পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এ অঞ্চলের নদীগুলোর রয়েছে মায়াবী আহ্বান। সাগরকন্যা কুয়াকাটা এবং এশিয়ার সর্ববৃহৎ পেয়ারা বাগান ছাড়াও বরিশাল জেলাতেই ৩৮টি পর্যটন স্পষ্ট রয়েছে পর্যটন বিভাগের হিসেবে । বরিশাল জেলার ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এসব দর্শনীয় স্থান। এরমধ্যে অন্যতম বাংলার ফ্লোটিং মার্কেট হিসাবে খ্যাত কুড়িয়ানার ভাসমান পেয়ারা বাজার, মেহেন্দিগঞ্জের উলানিয়া জমিদার বাড়ি, লাকুটিয়া জমিদার বাড়ি, আরজ আলী মাতুব্বর পাঠাগার, সদর উপজেলার চাঁদপুরা ইউনিয়নের গজনীর দিঘি, দুর্গাসাগর দিঘী, গুঠিয়া মসজিদ, সাতলা শাপলা গ্রাম, বিবির পুকুর, ব্রজমোহন কলেজ, জীবনানন্দ দাশ এর বাড়ি, অক্সফোর্ড মিশন গীর্জা, বঙ্গবন্ধু উদ্যান(বেলস পার্ক), মুক্তিযোদ্ধা পার্ক, ত্রিশ গোডাউন, বধ্যভূমি, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, শ্বেতপদ্ম পুকুর, মুকুন্দ দাসের কালিবাড়ী ও শের-ই-বাংলা জাদুঘর এবং বরিশাল নৌ বন্দর থেকে দু’পাশে বিস্তৃত ১০ কিলোমিটার নদী রক্ষা বাঁধের ওয়াকওয়ে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দর্শনার্থী ও পর্যটকদের ভিড় খুঁজে পাওয়া যায় দূর্গা সাগর, মুক্তিযোদ্ধা পার্ক, ত্রিশ গোডাউন এবং নদী তীরবর্তী বেড়িবাঁধ এলাকায়। যেখানে টুরিস্ট পুলিশের প্রয়োজনীয়তা সার্বক্ষণিক অনুভব করেন বলে জানান স্থানীয় ব্যবসায়ী ও দর্শনার্থীরা।
বরিশালের অন্যতম বিনোদন স্থান হিসেবে পরিচিত ত্রিশ গোডাউন ও মুক্তিযোদ্ধা পার্কে নিয়মিত সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনাকারী তিনটি সংগঠন বরিশাল সাহিত্য সংসদ (বসাস) তরঙ্গ এবং জাগ্রত বরিশাল। বসাস এর সভাপতি কাজী মিজানুর রহমান বলেন, বরিশালের জেলার সবচেয়ে জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্পষ্ট হচ্ছে দূর্গা সাগর। আর জেলার বাইরে হলেও বরিশালেরই অংশ ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও বরিশালের বানারিপাড়ার কিছু অংশ নিয়ে গঠিত এশিয়ার সর্ববৃহৎ পেয়ারা বাগান এবং ভাসমান পেয়ারা বাজার অন্যতম পর্যটন স্পষ্ট এখন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এসব স্পষ্টে দর্শনার্থীদের জন্য কোনো সুব্যবস্থা নেই। নেই কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ফলে দিনের আলোতেই ফিরে আসতে হয় সবাইকে।
কাজী মিজান আরো বলেন, শহরের ভিতরে এই মুক্তিযোদ্ধা পার্কের আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখুন, এটি খুবই চমৎকার একটি দর্শনীয় ও উপভোগ্য স্থান হতে পারতো যদি এখানে এতোগুলো সরকারি নৌযানের ঘাটি তৈরি না হতো। এই ঘাটতিগুলো মুক্তিযোদ্ধা পার্ক এলাকা থেকে সরিয়ে ফেলা এবং এখানে নিয়মিত টুরিস্ট পুলিশের টহল থাকলে এটিও অন্যতম পর্যটন স্পষ্ট হতে পারে।
জাগ্রত বরিশাল এর কর্ণধার সংগঠক বেলাল আহম্মেদ শান্ত বলেন, বরিশাল ৫ আসনের সংসদ সদস্য পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কর্ণেল অবঃ জাহিদ ফারুক শামীম এর ঐকান্তিক চেষ্টায় বরিশালে নদীর এপারে লাকুটিয়া, ওপারে চরকাউয়া অংশে নদী রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এই বাঁধকে ঘীরে তৈরি হয়েছে পর্যটন সম্ভাবনা। প্রতিদিন বিকেলবেলা অসংখ্য মানুষের সমাগম ঘটে এই বাঁধ এলাকায়। কিন্তু নিরাপত্তাহীনতার কারণে সন্ধ্যার পরে বাঁধ এলাকায় অবস্থান করা ঝুকিপূর্ণ হয়ে যায়।
তিনি আরো বলেন, এই যে ত্রিশ গোডাউনের নদী তীরবর্তী এলাকায় সন্ধ্যার পর যে ভিড়টা দেখতে পাচ্ছেন, তা শুধু এখানে এপিবিএন বিভাগীয় হেডকোয়ার্টার ও টুরিস্ট পুলিশের নিয়মিত টহল আছে বলে।
অন্যদিকে দূর্গা সাগর, শের ই বাংলার বাড়িসহ জেলার প্রতিটি পর্যটন স্পষ্টে টুরিস্ট পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধি ও নিয়মিত টহল ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দাবী জানান বানারিপাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক। তিনি বলেন, এখানে জমিদার বাড়ি বা পেয়ারা বাগান এলাকা সন্ধ্যার পর নিরাপদ নয়। তাই আমরা বিকেল ৫ টা হলেই আর কাউকে ওদিকটায় যেতে নিষেধ করি।
মাত্র কিছুদিন আগেই গত ২ আগস্ট বরিশাল ঘুরে গেছেন ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূত
হেরু হারতান্তো সুবোলো। তিনি এশিয়ার সর্ববৃহৎ পেয়ারা বাগান ও বাজার ঘুরে দেখে এখানে পর্যাপ্ত শিল্পায়নের সুযোগ রয়েছে উল্লেখ করে ইন্দোনেশিয়ার ব্যবসায়ীদের এখানে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করবেন জানিয়েছেন। একইসাথে তার সফরসঙ্গী মিসেস সুবোলো ও থার্ড সেক্রেটারি ফিতরি নুরুল ইসলামি বলেছেন, ওখানে পর্যটকদের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা কোনো বিশ্রামাগার ও ওয়াশরুম না থাকা। আর স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবী পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হলে আটঘর কুড়িয়ানা হবে সুন্দরবনের মতোই জনপ্রিয় পর্যটন স্পষ্ট।
এ বিষয়ে সহমত পোষণ করেন পিরোজপুর জেলার নেছারাবাদ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুব উল্লাহ মজুমদার। তিনি বলেন, রাষ্ট্রদূত বা সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে পুলিশ প্রশাসনের নিরাপত্তা বেষ্টনী থাকে। কিন্তু সাধারণ দর্শনার্থী বা পর্যটকদের জন্য সে ব্যবস্থা নেই। তাই আমরা সবাইকে দিনের আলোতেই ফিরে আসতে অনুরোধ করি। এখানে টুরিস্ট পুলিশের সার্বক্ষণিক ক্যাম্পের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এই কর্মকর্তা নিজেও। পাশাপাশি এখানে উন্নত মানের আবাসিক ব্যবস্থা তৈরিতে ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
বরিশালের চারদিকে এরকম অসংখ্য পর্যটন সম্ভাবনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সাতলার শাপলা বিল, বানারিপাড়া ও উজিরপুরের ভাসমান সবজী খামার, বরিশাল সদরের পদ্ম পুকুর, বেলস পার্ক বা বঙ্গবন্ধু উদ্যান, গজনীর দিঘিতে নিয়মিত টহল পুলিশের দাবী এলাকাবাসীর।
টুরিস্ট পুলিশ সুত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ পুলিশের একটি বিশেষায়িত ইউনিট ‘ট্যুরিস্ট পুলিশ’। পর্যটকদের নিরাপত্তা ও পর্যটন শিল্প বিকাশে ২০১৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর চালু হয় এ ইউনিট। গঠনের নয় বছর পরও এর জনবল বাড়েনি। নেই পর্যাপ্ত অপারেশন ইকুইপমেন্ট। টুরিস্ট নারী পুলিশ খুবই জরুরী হলেও তা উপেক্ষিত বারবার।
ট্যুরিস্ট পুলিশ সূত্রে আরো জানা গেছে, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারসহ সাত শতাধিক পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে বাংলাদেশে। পর্যটন করপোরেশনের হিসাব মতে, প্রতিবছর এসব পর্যটন এলাকায় ভ্রমণ করেন ৬০ লাখ দেশি-বিদেশি পর্যটক। প্রতিষ্ঠালগ্নে ৬৯৯ সদস্য ও কর্মকর্তা নিয়ে যাত্রা শুরু করে ট্যুরিস্ট পুলিশ। ২০১৫ সাল থেকে শুরু হয় আনুষ্ঠানিক অপারেশনাল কাজ। দেশের ৩৬টি জেলায় ট্যুরিস্ট পুলিশের কার্যক্রম বিস্তৃত। এই মুহূর্তে তাদের জনবলের সংখ্যা মাত্র ১২শ ৫৬ জন। বরিশাল বিভাগের প্রায় দেড়শত পর্যটন স্পষ্টের জন্য সর্বমোট ৯৯ জন টুরিস্ট পুলিশ সদস্য রয়েছেন। এরমধ্যে কুয়াকাটায় ৪৩ জন, ভোলায় ১৯ জন এবং বরিশালে ২২ জন বলে জানা গেছে। টুরিস্ট পুলিশের হিসাবেই বরিশালে পর্যটনের স্পট ৩৮ টি। তাহলে এই ২২ জন সদস্য কি করে সামলাবেন এই স্পষ্টগুলো?

পর্যটন স্পষ্টগুলো টুরিস্ট পুলিশের নিয়ন্ত্রণে দেয়া হলেও আমাদের পর্যাপ্ত লোকবল নেই বলে জানান বরিশালের বান্দরোডে মু্ক্তিযোদ্ধা পার্কে আকস্মিক পরিদর্শনে আসা টুরিস্ট পুলিশের ছয়জনের টিম প্রধান এসআই সহিদ। তিনি বলেন, আমরা এখানে কিছুক্ষণ থেকেই চলে যাবো ত্রিশ গোডাউন এলাকায়, সেখান থেকে আবার নদী রক্ষা বাঁধ এলাকা হয়ে আটটার মধ্যে ফিরে আসতে হবে। শহরের জন্য আমরা এই ক’জন নিয়মিত আছি।
প্রচন্ডভাবে লোকবল সংকট টুরিস্ট পুলিশের একথা স্বীকার করে টুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত সুপার আবুল কালাম আজাদ বলেন, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সমাগম ঘটে। বিশেষ করে বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটা আমাদের বাংলাদেশের সম্মানের বিষয়। তাই টুরিস্ট পুলিশের বড়ো একটি অংশ কুয়াকাটাকে ঘীরে থাকে। সেখানে দেখবেন পরিচ্ছন্নতা থেকে শুরু করে টাকা, মোবাইল, শিশু সন্তান হারিয়ে যাওয়ার খোঁজ করা সবটাই অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সাথে করছে টুরিস্ট পুলিশ। আমাদের লোকবল সংকট দূর হলেই আমরা বরিশাল বিভাগের সবগুলো পর্যটন স্পষ্ট কঠিন নজরদারিতে আনতে পারবো বলে জানান এএসপি আজাদ।

সংবাদটি শেয়ার করুন ...

এই বিভাগের আরো সংবাদ...
© All rights reserved © ২০২৩ স্মার্ট বরিশাল
EngineerBD-Jowfhowo