ভোক্তা অধিকার ভোক্তাদের তুলনায় কতিপয় ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিয়ে সাফাই গাওয়াতে ভোক্তার অধিকার যেনো জনসাধারণের কাছে বই আর আইনের পাতাতেই সীমাবদ্ধ! ভোক্তাদের অধিকার আদায়ের তুলনায় ব্যবসায়ীদের সুযোগ সুবিধা দেয়ার চিত্রই বর্তমানে দায়িত্বশীলদের কর্মকান্ডে ফুটে উঠেছে।
বরিশালের বিভিন্ন মনোহরী দোকান ও বেকারীতে যখন ৮০০ গ্রাম ওজনের একটি পাউরুটি ৮০, ৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, তখন একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান একই ওজনের পাউরুটি বিক্রি করছে ১১০ টাকায়। দামের এই পার্থক্য নিয়ে গ্রাহকদের অনেকেই অভিযোগ তুললেও ভোক্তা অধিকার বলছে, গুনগত মানের পার্থক্য আছে। তাই এটা ঠিক আছে। যদিও গ্রাহকদের অভিযোগ একই ওজনের পাউরুটির দাম সকলের সমান হওয়া উচিত। মানের তারতম্য দেখার দায়িত্ব ভোক্তা অধিকারের গ্রাহকদের নয়। অন্যদিকে যারা বেশি দাম নিচ্ছে তাদের প্রতিষ্ঠান সমিতিভুক্ত নয় এবং এদের বিএসটিআইয়ের অনুমোদনও নেই বলে দাবী বেকারী মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দের। যদিও ১১০ টাকায় পাউরুটি বিক্রি করা প্রতিষ্ঠানের মালিক সবাইকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছেন, আমার প্রতিষ্ঠানের পাউরুটির মান আর এই শহরের অন্যদের তৈরি পাউরুটির মানে অনেক ব্যবধান রয়েছে। আমি যেসব উপকরণ ব্যবহার করছি তা যদি তারা ব্যবহার করে পাউরুটি তৈরি করতেন তবে তারা দাম আরো বেশি নিতেন। বর্তমান বাজারের উর্ধগতি অব্যাহত থাকলে আমাকে দাম আরো বাড়াতে হবে বলে জানান তিনি।
সরজমিনে গত বুধবার বরিশালের কয়েকটি পাউরুটি তৈরি কারখানা ও বেকারির দোকান ইত্যাদি, শাহাবুদ্দিন, আল আমিন, চান এবং থ্রী এস পেস্ট্রি শপ ঘুরে জানা গেছে এ-সব তথ্য। সদর রোড ও সিটি করপোরেশন ভবনের পাশের বেকারি ঘুরে দেখা যায়, ৮০০ গ্রাম ওজনের পাউরুটি শাহাবুদ্দিন, আল আমিন ও ইত্যাদি বিক্রি করছেন ৯৫ টাকা দরে। ফ্রেশ পাউরুটি ৮৫ টাকা এবং থ্রী এস পেস্ট্রি শপে একই পাউরুটি ১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দামের এই হেরফের অন্যান্য বিস্কুট, কেক বা ছোট রুটিতেও। থ্রী এস পেস্ট্রি শপে তিন ধরনের পাউরুটি রয়েছে। যা ৫০, ৭০ ও ১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একই সাইজের ছোট, মাঝারি ও বড় পাউরুটি অন্যরা বিক্রি করছেন ৪৫, ৬৫ ও ৯৫ টাকায়। দামের এই তারতম্য এবং সমিতিভুক্ত না হওয়া নিয়ে থ্রী এস পেস্ট্রি শপের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন সয়ং সমিতির সভাপতি ও ফ্রেশ বেকারির মালিক কাজী মামুনও।
তিনি বলেন, বেকারী মালিক সমিতিভুক্ত ৪০টির মতো প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যাদের প্রত্যেকের নিজস্ব কারখানা রয়েছে। এজন্য সমিতির নির্ধারিত মূল্য তালিকাও রয়েছে। যেখান ৮০০ গ্রাম একটি পাউরুটির পাইকারি মূল্য ৮০ টাকা খুচরা মূল্য ৮৫ টাকা। এর উপরে যারা বিক্রি করে তারা কেউই সমিতি ভুক্ত নয়। এমনকি তাদের বিএসটিআইয়ের অনুমোদন পর্যন্ত নেই বলে জানান তিনি।
মামুন আরো বলেন, আমরা লাখ লাখ টাকা খরচ করে ব্যবসা করছি। অথচ এরা এসেই কোনোরকম নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে আমাদের ব্যবসার ক্ষতি করছে। আমি এজন্য জেলা প্রশাসনের মিটিং এ বারবার প্রশাসনের নজরদারি বাড়াতে অনুরোধ জানিয়ে আসছি।
বরিশালের মহানগরীর বিভিন্ন বাজার ও বেকারি ঘুরে যদিও হাতেগোনা কয়েকটি পাউরুটি তৈরি কারখানার নাম পাওয়া যায় এদের মধ্যে লোকমুখে প্রচলিত বেকারি হিসেবে চকবাজার রোডের চান বেকারী অন্যতম। অনেক পুরাতন এই বেকারীর কারখানা এখনো সনাতন পদ্ধতিতে রুটি, বিস্কুট, চানাচুর, কেকসহ বিভিন্ন খাবার তৈরি করছে। তাদের দোকানেও ৮০০ গ্রাম ওজনের পাউরুটি বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়। আগে এটি ছিলো ৭৫ টাকা। বরিশালের জেলা পরিষদ মার্কেটের বিপরীতে অবস্থিত হাজী ফকির চান বেকারীর ম্যানেজার তোতা মিয়া বলেন, জিনিসপত্রের যেভাবে দাম বাড়ছে তার সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে রুটির দামও বাড়াতে হবে। আমরা ময়দার দাম বাড়ার পর ৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০০ গ্রাম একটি রুটি ৮০ টাকায় বিক্রি করছি। এরপর ইতিমধ্যে চিনি, তেল ও ডিমের দাম বেড়েছে। আমরা এখনো দাম সমন্বয় করিনি তাই একইদাম রয়ে গেছে বলে জানান তোতা মিয়া।
বরিশালের থ্রী এস পেস্ট্রি শপের স্বত্বাধিকারী মোঃ জসিম মের্ধা। তিনি ও তার ছোটো ভাই আলাউদ্দিন দুজনেই সৌদি আরবের একটি নামকরা প্রতিষ্ঠানে শেফ হিসেবে কাজ করতেন। ২০১৭ সালে বরিশালে ফিরে এসে তারা থ্রী এস পেস্ট্রি শপ চালু করেন নতুন বাজার সংলগ্ন বনমালী গাঙ্গুলি এর সামনে। সেখান থেকে আজ বরিশালে চারটি, ঝালকাঠি ও পটুয়াখালীতে ১টি করে মোট ৬টি দোকান এবং তিনটি কারখানায় তাদের। মোঃ জসিম তার গুদাম, কারখানা এবং পাউরুটি তৈরির উপকরণ দেখিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন বরিশালের অন্যসব কারখানার প্রতি। বলেন, আমরা যেসব উপকরণ ব্যবহার করছি তা অন্যকোনো প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করলে তাদের পাউরুটির দাম আরো বেশি হবে।
দু-একটি ছোটখাটো ভুল ছাড়া থ্রী এস পেস্ট্রি শপের আর কোনো সমস্যা খুঁজে পাননি বলে জানান বরিশাল ভোক্তা অধিকারের উপপরিচালক অপূর্ব অধিকারীও। তিনি জানালেন, দামের তারতম্যের সাথে মানেরও যথেষ্ট তারতম্য রয়েছে। ১১০ টাকা দামের পণ্যটির সাথে ৮০ বা ৯০ টাকার পণ্যটির মানের অনেক পার্থক্য আমরা পেয়েছি।
অপূর্ব অধিকারী আরো বলেন, নগরীর মধ্যে বিএসটিআইয়ের অনুমোদনহীন কাউকে পাওয়া যায়নি তবে নগরীর বাইরে প্রতিষ্ঠান রয়েছে যাদের বিএসটিআইয়ের সম্পর্কে ধারণা ছিল না, আমরা তাদের বিএসটিআইয়ের নাম ঠিকানা দিয়ে এসেছি।
তবে বরিশাল নগরীর সমিতি ভুক্ত বেকারী মালিকদের দাবী, ভোক্তা অধিকারের কর্মকর্তাদের সাথে থ্রী এস পেস্ট্রি শপে ও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বেশ দহরমমহরম রয়েছে। যে কারণে তারা দামের তারতম্য বা বিএসটিআইয়ের অনুমোদন বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না।
আর নিয়মিত সকালের নাস্তায় পাউরুটি ব্যবহার করেন এমন কয়েকজন গ্রাহক বলেন, থ্রী এস পেস্ট্রি শপের পাউরুটি এবং চান বেকারীর পাউরুটি স্বাদ একইরকম। তাহলে চান বেকারী ৮০ টাকায় বিক্রি করলে তারা কেন ১১০ টাকায় বিক্রি করছেন? গ্রাহকদের এ প্রশ্ন ভোক্তা অধিকারের কাছে। উত্তরে ভোক্তা অধিকার বরিশালের উপপরিচালক অপূর্ব অধিকারী একই কথা বলেন, মানের পার্থক্য রয়েছে। আমরা যাচাই করে দেখেছি। প্রয়োজনে আবার যাচাই করবো। লিখিত অভিযোগ দিন। অভিযোগ ছাড়া তো আমরা কিছু করতে পারিনা।