‘সাত–আট বছর ধরে এভাবেই ফাঁকা পড়ে আছে বাক্সটি। এখন কেউ আগের মতো আর চিঠি লেখে না। যে দু-একটা চিঠি আসে, সেগুলো ডাকপিয়ন হাতে করেই পৌঁছে দেয়,’ বলছিলেন হলটির পাহারাদার মজিবুর রহমান।
ঢাবি এলাকায় চিঠি বিলির কাজে নিয়োজিত আছেন চারজন ডাকপিয়ন। তাদের একজন জাহিদুল ইসলাম চার বছর ধরে সূর্য সেন হল, প্রশাসনিক ভবনসহ আশপাশের এলাকায় চিঠি বিলি করেন। তিনি বলেন, ‘চাকরির শুরু থেকেই ঢাবি এলাকায় চিঠি বিলির দায়িত্বে আছি। যাদের চিঠি, আমি সরাসরি তাদের হাতে দিয়ে দিই। চিঠির বাক্স তাই এখন আর দরকার পড়ে না।’
ডাকপিয়ন জাহিদুলের হাতে থাকে কালো রংয়ের ব্যাগ। এ ব্যাগেই জমা হয় প্রতিদিনের সব চিঠি। পুরোনো দিনের সাইকেলে চড়ে আসা ডাকপিয়ন নন তিনি। এসেছেন রিকশা করে। ডাক বিভাগ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে তার জন্য ভাড়া বরাদ্দ চল্লিশ টাকা। অবশ্য এ টাকায় হয় না, নিজের গাঁট থেকে কিছু খরচ করতে হয়। ‘হলের ভাইদের হাতে হাতে চিঠি দিই। কারও নতুন চাকরির চিঠি, মানি অর্ডার, কারও বা অন্য দরকারি চিঠি। কিন্তু তেমন ব্যক্তিগত চিঠি আসে না।’
তবুও খুলি চিঠির বাক্স
ঢাবি’র বিভিন্ন হলসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অনেকগুলো চিঠির বাক্স চোখে পড়ে। তবে ঠিক কতটি চিঠির বাক্স রয়েছে এবং সেগুলো আদৌ খোলা হয় কি না এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই খোদ বিশ্ববিদ্যালয় পোস্ট অফিসের কাছে। তাদের পরামর্শে বাংলাদেশ ডাক বিভাগে যোগাযোগ করেও ব্যর্থমনোরথ হয়ে ফিরতে হলো। বুঝলাম, আধুনিকতার এ যুগে চিঠির বাক্সের গুরুত্ব তেমন নেই; রিক্ততা আর উপেক্ষাই এগুলোর নিয়তি।
তবে বাক্সগুলো এখনো খোলা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিঠির বাক্স খোলেন আব্দুল্লাহ হিল কাফি। গত চার দশক ধরেই করছেন এ কাজ। সম্প্রতি অবসরে গিয়েছেন, তবে এখনো বাক্স খোলার কাজটি করে যাচ্ছেন। কাফি বলেন, ‘ঢাবিতে চিঠির বাক্স রয়েছে পাঁচটি। স্যার এ. এফ. রহমান হলের সামনে একটি, শামসুন্নাহার হলে একটি, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের গেইটে একটি, আর বাকি দুটি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার মধ্যেই।’
এগুলোর বাইরেও আরও কিছু বাক্স রয়েছে, তবে এ পাঁচটি বাক্সই এখনো কিছুটা সচল — এখনো কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়নি। কাফি বাক্সগুলো নিয়মিতই খোলেন, কিন্তু চিঠি পাওয়াটাই কেবল হয়ে ওঠে না। তিনি বলেন, ‘এখন তো আর আগের মতো কেউ চিঠি লেখে না। তবুও বাক্সগুলো খুলি। কখনো কখনো দু-একটা চিঠি পাই। অনেক সময় কিছুই থাকে না। তবুও খুলি।’
‘গত সপ্তাহেও খুলেছি। শামসুন্নাহার হল, মুহসীন হলের চিঠির বাক্স খুলে একটা চিঠিও পাইনি। শুধু এফ. রহমান হল থেকে একটি চিঠি পেয়েছি।’
কল্পনা করলাম, চিঠিটা যিনি লিখেছেন, তিনি হয়তো কোনো তরুণী। হলটির কোনো ছেলেকে হয়তো তার পছন্দ, কিন্তু মুখে বলতে পারছেন না। আজকাল হোয়াটসঅ্যাপ-মেসেঞ্জারেতো সবাই লেখে — কিন্তু নিজের প্রেমের গভীরতা বোঝাতে তিনি হয়তো খুব যত্ন করে চিঠি লিখেছেন।
বদলে গেছে চিঠির ধরন
গত শতকের পঞ্চাশের দশকে ডাকপিয়ন পায়ে হেঁটে বাড়িতে বাড়িতে চিঠি নিয়ে আসতেন। ষাটের দশক থেকে তিনি সাইকেলে চড়ে চিঠি বিলি শুরু করলেন। প্রিয়জনের একটি চিঠির জন্য তখন সবাই তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষায় থাকত। কুরিয়ার সার্ভিসের যুগে এসেও মানুষ চিঠি দিতে ভুলে যায়নি, যদিও ডাকপিয়নের সাইকেলের টুংটাং আওয়াজ আর শোনা হয়নি।
সেসব চিঠিতে প্রিয় মানুষের শব্দে-শব্দে অনুভূতি আর ভালোবাসা গাঁথা ছিল। কিন্তু সে যুগ এখন বিগতযৌবনা, কেবল স্মৃতিতেই কোনোমতে টিকে আছে। মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমেইলের যুগে মানুষের চিঠি লেখার সময় কই, ইচ্ছেটুকুও কি আছে!
চিঠি শব্দটি শুধুই এখন প্রশাসনিক কাজেরই অংশ নাকি ব্যক্তিগত চিঠিও কেউ কেউ কালেভদ্রে লেখেন? আর সেই গুটিকয় চিঠি হাতে-হাতেই পৌঁছে যায়, চিঠির বাক্সে ক্ষণিকের তরে আশ্রয় নেওয়ার প্রয়োজন হয় না?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্টমাস্টার শেখ নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘এখন তো আর চিঠি তেমন আসে না। কিছু চিঠি আসে, কিন্তু সেগুলো প্রশাসনিক কাজের জন্য। ব্যক্তিগত চিঠি তেমন একটা আসে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাক্সগুলো খুললেও চিঠি পাওয়া যায় না।’
বাংলাদেশ ডাক বিভাগের ডেলিভারি শাখায় দায়িত্বরত ডেপুটি পোস্টমাস্টার ওবায়দুল হক বলেন, ‘চিঠি যা আসে সেগুলো বিভিন্ন দাপ্তরিক বা সরকারি কাজের; ব্যক্তিগত চিঠি তেমন আসে না।’
তবে শুধু চিঠি নয়, ডাক যোগাযোগে মানি অর্ডার, পোস্টাল অর্ডার সার্ভিস, এক্সপ্রেস মেইল সার্ভিস (আন্তর্জাতিক), রেজিস্ট্রার্ড নিউজপেপার, স্পিড পোস্ট ইত্যাদি সেবা এখনো চলমান।
চিঠির গল্প
মাস্টারদা সূর্য সেন হলের পাহারাদার মজিবুর রহমান তার বায়ান্ন বছরের জীবনের পুরোটাই কাটিয়েছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাবাও হলের পাহারাদার থাকায় মজিবুরের জন্ম-বেড়ে ওঠা সবই এখানে। চিঠি নিয়ে তারও গল্পের শেষ নেই। ‘একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব যোগাযোগতো চিঠির মাধ্যমেই হতো। তখন দেখতাম চিঠি পেয়ে কখনো ছেলেরা কান্নাকাটি করেছে। অনেকদিন পর পরিবাবরের কারও চিঠি পেয়ে আনন্দের চিৎকারও শুনেছি।
‘ওরা গেইট থেকেই চিঠি খুলে পড়া শুরু করত। এখন তো আর কেউ চিঠিই লেখে না। এখন কান্নাকাটি করে মোবাইলে,’ মজিবুর স্মৃতিচারণ করেন।
‘তখন আমরা নিজেরাও চিঠি লিখেছি, চিঠি পেয়েছি । কিন্তু এখন গেইটের বাক্সটাও খালিই পড়ে থাকে। যে কয়েকটা চিঠি আসে, রুম নম্বর লেখা থাকে, ডাকপিয়ন এসে হাতে হাতেই দিয়ে যায়,’ বলেন তিনি।
কিন্তু এ প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের মাঝে কি চিঠি নিয়ে কোনো আবেগ কাজ করে? এ সময়ে এসে তারাও কি কখনো চিঠি পেতে কিংবা দিতে আগ্রহবোধ করেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী তামজিদ বলেন, ‘চিঠিতে যে আবেগ প্রকাশ করা যায়, অন্য কোনো মাধ্যমে তা সম্ভব হয় না। মনে হয় এটা যেন আমার নিজের কিছু। আমরা সবাই চাই, কেউ আমাদের চিঠি দিক। কারণ চিঠি পেতেই বেশি ভালো লাগে।’
ওবায়দুল হক হয়তো ঠিকই বলেছেন, ইন্টারনেট আছে বলে চিঠির তেমন প্রয়োজন হয় না। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পেছনে যে আবেগ আমরা ফেলে এসেছি — খামে ভরা শব্দে-শব্দে ভালোবাসার ডাক কিংবা বিষণ্ণ হৃদয়ভাঙার গল্প, অথবা নতুন বিপ্লবের ডাক, নতুন সূচনার আহ্বান — সেই আবেগ, হলুদ খামের সেই গন্ধ, সেই চিঠি, সেই চিঠির লাল বাক্স আমাদেরকে কি তাড়িত করবে না অনুভূতির জগতে, কিছু সময়ের জন্য অথবা সব সময়ের জন্য ?