একজন দিনমজুর থেকে হঠাৎ করে কোটিপতি বনে যাওয়া সমাজসেবক এর তোকমা লাগিয়ে কালোটাকার আধারে থাকা আলোর ঘটনা রটছে বরিশালের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে বিভিন্ন এলাকায়। বরিশাল সদর উপজেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়নের দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান সালাউদ্দিন রিপনের হঠাৎ করে সমাজসেবামূলক কার্যক্রমের অংশ নিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপি হিসেবে প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় আসলে তার কোটিপতি বনে যাওয়ার বৈধ নথিপত্র সহ তার চাচার কাছে যাওয়ার পর পর ই বছরের মাথায় আকস্মিক মৃত্যুর বিষয় টিও যেনো অপেক্ষাকৃত থলের বেড়াল বেড়ানোর !
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশাল-৫ আসনে ট্রাক মার্কা স্বতন্ত্র প্রার্থী সালাউদ্দিন রিপন প্রায় দুই যুগ আগে ছিলেন একজন দিনমজুর। বাবা আব্দুল মান্নান হাওলাদারের সাথে তিনি বরিশাল সদর উপজেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়নের বাটনা গ্রামে কৃষি কাজ করতেন। স্থানীয় আমীরগঞ্জ হাট, কাগাশুরা ও বাবুর হাটে কৃষি ফসল বিক্রিসহ দিনমজুরীর কাজ করে জীবন-যাপন করতেন। রিপন ২০০৩ সালে ৩ হাজার টাকা বেতনের চুক্তিতে গ্রাম ছেড়ে শহরে চাচার বাসায় চলে যায়। চাচা রফিকুল ইসলাম ছিলেন ঢাকা রেলওয়ের ঠিকাদার। ২০০৪ সালে হঠাৎ অসুস্থ্য হয়ে মৃত্যুবরণ করেন রফিকুল ইসলাম। চাচার মৃত্যুর পরই কূটকৌশলে চাচতো বোনকে বিয়ে করেই কোটিপতি বনে যায় রিপন। অর্থ আত্মসাতের পর বউয়ের উপর অত্যাচার শুরু করে চলে যেতে বাধ্য করে। বছর কয়েক পরই প্রতিষ্ঠিত করেন ’এস আর সমাজকল্যাণ সংস্থা’ নামক একটি সংগঠন। সারসী নতুন হাটসহ উপরোক্ত এলাকার হাট-বাজারের চায়ের দোকানগুলোতে রিপনকে নিয়ে জনমুখে ওই সব আলোচনার পাশাপাশি সমালোচনার ঝড় বইছে। গত ৭ বছরে বরিশাল সদর উপজেলার ১০টি ইউনিয়নসহ সিটির ৩০টি ওয়ার্ডে ‘এস আর সমাজকল্যাণ সংস্থা’ জনস্বার্থে প্রায় ১০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। সংগঠনটির নেতা কর্মীরা এমন বক্তব্য দেয়ার পরই তোলপাড় শুরু হয় বরিশাল-৫ আসনের অধিকাংশ জনমনে।
সরেজমিনে পরিদর্শনকালে প্রতিবেদকের কয়েকটি প্রশ্নের জবাবে আমীরগঞ্জ, কাগাশুরা, বাবুর হাট ও সারসী নতুন হাট এলাকার একাধিক ব্যক্তি বলেন, রিপন ভাই টাকা দিচ্ছি তাই আমরা নির্বাচনী ওয়ার্কে নেমেছি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দল থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন কিন্তু দলের পক্ষে চোখে পরার মত রিপনের কার্যক্রম না থাকায় পায়নি। তবে কিছুটা হলেও বরিশালের কিছু সংখ্যক মানুষের মন কেড়ে নিয়েছে ‘ এস.আর সমাজক্যালণ সংস্থা’ । তারা বলেন, শুনেছি রেল সেক্টর এখনো সরকারের ভর্তুকি দিয়ে চলে। সরকার প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা রেলের জন্য লোকসান দিচ্ছে সেখানে রিপনের মত একজন রেল ব্যবসায়ী সরকারের কাছ থেকে রেল ইজারা নিয়ে মাত্র কয়েক বছর ব্যবধানে কোটি কোটি টাকা কিভাবে আয় করেছেন? অথচ ক’বছরে রেল খাতে সরকারের লোকসান দিতে হয়েছে প্রায় ক’শতাধিক কোটি টাকা। সরকার বছরের পর বছর লোকসান দিলেও রিপনের মত দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীরা হয়ে উঠছেন জিরো থেকে হিরো। রেল ব্যবসার আড়ালে রেলে অবৈধ চোরাচালান ও পাচারের মত ভয়ংকর অপরাধের সাথেও জড়িত থাকতে পারে বলে ধারণা তাদের। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করলেই সালাউদ্দিন রিপনের বিপুল অর্থৈর উৎস কোথায়? সেই রহস্য উঠে আসতে পারে বলে অনেকেই মনে করছেন।
বিষয়টিতে কেউ বলেছেন, চাচার মৃত্যুর পর অর্থ আত্মসাতের সুযোগ হাতছাড়া করেনি রিপন। সবকিছু নিজের মত ঘুছিয়ে নিয়ে আবার চাচতো বোনকে বিয়ে করে বাকী অর্থ সম্পত্তিও নিজের কব্জায় নিয়ে নেয়। সব সম্পত্তি হাতের মুঠোয় আসার পরই বেপরোয়া হয়ে উঠে রিপন। পরিকল্পনানুযায়ী সংসারে প্রথম স্ত্রীর (চাচতো বোন) বিদায়ের ঘন্টা বাজিয়ে নোয়াখালীতে আরেকটি বিয়ে করেন রিপন। চাচার সম্পদ আত্মসাতে রাতা-রাতি কোটিপতির বনে গিয়ে কয়েক বছর পরই বরিশালে এসে অর্থাৎ রিপন তার নিজ গ্রামের বাড়ীতে ‘ এস.আর সমাজক্যালণ সংস্থা’ এর সাইন বোর্ড লাগিয়ে সেই অবৈধপন্থার অর্থ দিয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী স্থানীয় গরীব মানুষের মাঝে, ছাগল, সেলাই মেশিন, শীতার্তদের কম্বল ,টিন, চিকিৎসা সেবার জন্য অর্থ, ছেলে-মেয়ের বিয়েতে অর্থ, গর্ভবর্তী নারীর চিকিসার সময় অর্থ, শিক্ষার্থীদের মাঝে অর্থসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সহায়তা দিয়ে আসছেন। আবার এমপি হবার স্বপ্ন দেখছেন রিপন! নির্বাচনে অংশও নিয়েছেন।
আবার কেউ বলছেন, নির্বাচন আসলেই এলাকায় আগমন ঘটে রিপনের। ঢাকায় বসে যেভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছেন তাতে ক্ষমতা অনেকটাই দুর্বল। তাই নিজ এলাকায় এমপি নির্বাচন করে জয়ী হলে ঢাকা জতীয় সংদস ভবনের সদস্য হলে ক্ষমতার প্রভাব বিস্তার করতে পারবে। একই সাথে তার ব্যবসায় নেমে আসবে সুফল। এমপির দাপটে ভাগ্যের চাকা আরো এক দাপ এগিয়ে যাবে। এমপি হবার আসায় আগেই বর্ষিয়ান এক আ.লীগ নেতাকে ধর্ম বাবাও ডেকেছিলেন রিপন। এখনও অদৃশ্য ক্ষমতার প্রভাবে গ্রামের মৃত চাচার সম্পত্তিও দখলে রেখেছে রিপন।
বরিশাল-৫ আসনে শক্ত অবস্থানে মাঠে ছিল নৌকা, ঈগল ও ট্রাক মার্কা পদ প্রার্থী। সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ দলের মনোনয়ন না পেয়ে বরিশাল-৫ আসনে স্বতন্ত্র (ঈগল মার্কা) হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকার অভিযোগে তার মনোনয়নপত্র বাতিল করেছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বাচনে প্রার্থিতা ফিরে পেতে চেম্বার বিচারপতির আদেশ বাতিল চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করেছেন সাদিক আবদুল্লাহ। আইনি ম্যারপ্যাচের মধ্যে ঈগল মার্কার অধিকাংশ সমর্থক গোপনে ট্রাক মার্কার হয়ে কাজ করছে। সে জন্য এবারের নির্বাচনে জয়ী হবার স্বপ্ন দেখছেন রিপন। তবে হঠাৎ ঈগল মার্কা প্রার্থীতা ফিরে পেলে স্বপ্ন ভেঙ্গে যেতে পারে রিপনের। স্থানীয় এ সব পলিটিক্সের মধ্য দিয়ে নির্বাচনী কার্যক্রম সম্পন্ন করে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা মার্কা প্রার্থী কর্ণেল (অবঃ) জাহিদ ফারুক শামীম। তবে আ.লীগের দু’স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থক ওপেনে-গোপনে ঐক্য হয়ে গেলে নৌকার জয়ের অবস্থান মুসকিল হতে পারে বলে কয়েক প্রবীণ রাজনৈতিক নেতার ধারণা।
শেখ রাসেল শিশু পার্কে ট্রাক প্রতীকের সালাউদ্দিন রিপনের নির্বাচনী ক্যাম্প করা হয়েছে শেখ রাসেল শিশু পার্কের জমিতে। সদর উপজেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়নের তালতলী বন্দরে প্রায় চার একর জমি অধিগ্রহণ করা হয় শেখ রাসেল শিশু পার্ক নির্মাণের জন্য।ওই জমিতে সীমানা প্রাচীর করে উপজেলা প্রশাসন। সেই সীমানা প্রাচীরের প্রবেশদ্বারসহ বেশ কিছু জমিতে কাপড় দিয়ে ঘের দিয়ে নির্বাচনী ক্যাম্প তৈরি করা হয় ট্রাক প্রতীকের। সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুব উল্লাহ মজুমদার বলেন, সরকারি জমিতে নির্বাচনী ক্যাম্প করা যাবে না।স্বতন্ত্র প্রার্থী সালাউদ্দিন রিপন যদি সরকারি জমিতে নির্বাচনী ক্যাম্প করে থাকেন তাহলে তা অপসারণ করা হবে। এ বিষয়টি জানা নেই বলে জানান সালাউদ্দিন রিপন। চাচার সম্পদ আত্মসাতের বিষয়টি আলোচনা করার পরই তিনি প্রাগ্রাম নিয়ে খুবই ব্যস্ত রয়েছেন বলে জানান দিয়ে মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।