সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী নজরুল ইসলামের বর্তমানে মাসিক বেতন সর্বসাকুল্যে ৫২ হাজার টাকা। ১৯৯৮ সালে চাকরির শুরুতে তার মাসিক বেতন ছিল ৮ হাজার টাকা। ১৯৯৮ সালের জুন থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি আয় করেছেন ৬০ লাখ ৭৮ হাজার ৮০০ টাকা। অথচ বিভিন্ন ব্যাংকে তার ও পরিবারের সদস্যদের নামে ৩২ অ্যাকাউন্টে লেনদেন করেছেন কোটি কোটি টাকা। তার একার ‘উপরি’ আয়ে পরিবারের সবাই এখন কোটিপতি। গড়েছেন স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ।
গৃহিণী স্ত্রী ও বেকার ভাইবোনের নামে ব্যাংকে হিসাব খুলে টাকা জমিয়েও শেষ করতে পারেননি। দুই চাচাতো বোনের নামেও করেছেন কোটি টাকার এফডিআর। নিজের দুর্নীতির টাকা নিরাপদ করতে স্ত্রী, ভাইবোনের সঙ্গে চাচাতো বোনদেরও ফাঁসিয়েছেন তিনি।
মানি লন্ডারিং মামলার তদন্ত শেষে নজরুল ইসলাম, তার স্ত্রী শাহনাজ পারভীন, ভাই তরিকুল ইসলাম, বোন সেলিনা বেগম, চাচতো বোন নিলুফা বেগম ও হালিমা বেগমের নামে শিগগিরই আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থার উপ-পরিচালক পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা এ মামলার তদন্ত শেষ করছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য জানা গেছে।
এদিকে, দুদকের মামলার পর হুলিয়া মাথায় নিয়ে নজরুল ইসলাম বহাল তবিয়তে চাকরি করছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। জানা গেছে, মামলার পর তিনি হাইকোর্টে জামিন আবেদন করেছিলেন। হাইকোর্ট তাকে ৬ সপ্তাহের জামিন দিয়ে নির্ধারিত সময় পর নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। কিন্তু নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ না করায় কাগজে-কলমে হুলিয়া জারি হওয়ায় বর্তমানে তিনি ‘পলাতক’। অথচ এ অবস্থায় তার দপ্তর তাকে চাকরিতে বহাল রেখেছে।
বিভিন্ন মাধ্যম জানা গেছে, নজরুল ইসলাম বর্তমানে পটুয়াখালী সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদে কর্মরত। এ বিষয়ে জানতে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তার মোবাইল ফোনে কল করেন এ প্রতিবেদক। পরিচয় দিয়ে কুশলাদি বিনিময়ের পর দুর্নীতির মামলায় তিনি জামিনে আছেন কিনা-এই প্রশ্ন করতেই নিরিবিলি সময়ে ফিরতি কল করার কথা জানিয়ে লাইন বিচ্ছিন্ন করেন। পরে আর তিনি কল করেননি।
দুর্নীতি মামলার পলাতক আসামি নজরুল ইসলাম কিভাবে আপনার অধীনে চাকরিতে বহাল-এমন প্রশ্নের জবাবে পটুয়াখালী সড়ক ও জনপথ বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মাসুদ খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে একটা জটিল মামলা আছে জানতাম। কিন্তু সে পলাতক আসামি, তার বিরুদ্ধে হুলিয়া আছে এটা আমার জানা নেই।
এরকম হলে বিষয়টি খতিয়ে দেখে অবশ্যই তাকে বরখাস্ত করা হবে। প্রধান প্রকৌশলী স্যার সেটা করবেন। কারণ দুর্নীতি মামলার পলাতক আসামি চাকরি করার যোগ্যতা রাখে না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তার এদিক-সেদিক করার অভ্যাস আছে শুনেছি। প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করেই সে ৪-৫ মাস আগে পোস্টিং নিয়েছে।’
জানা গেছে, দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান শেষে প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন বরিশাল জেলা কার্যালয়ে মামলা করেন সংস্থার সাবেক উপ-পরিচালক এদিপ বিল্লাহ।
মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২); দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৭(১) তৎসহ দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারায় মামলা হয়। এতে নজরুল ইসলামের স্ত্রী শাহানাজ পারভীন ও ভাই তরিকুল ইসলামকেও আসামি করা হয়। এরপর মামলার তদন্তে নজরুল ইসলামের দুর্নীতির সঙ্গে তার বোন সেলিনা বেগম ও চাচাতো দুই বোন নিলুফা বেগম ও হালিমা বেগমের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। নজরুল ইসলাম তার দুর্নীতিলব্ধ আয় নিরাপদ করতে এই তিনজনের নামে ব্যাংক হিসাবে এফডিআর করেন। মামলার অভিযোগপত্রে এদেরও আসামি করা হবে বলে তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।
জানা গেছে, নজরুল ইসলামের স্ত্রী শাহানাজ পারভীন গৃহিণী। তার নিজস্ব কোনো আয় নেই। তবে ২০২১-২২ করবর্ষে শাহানাজ পারভীন তার দাখিল করা আয়কর রিটার্নে নিজেকে ব্যবসায়ী হিসাবে দেখিয়েছেন। কিন্তু দুদকের তদন্তে তার ব্যবসার কোনো তথ্য মেলেনি। নজরুল ইসলামের ভাই তরিকুল ইসলামও বেকার। তার আয়ের কোনো উৎস নেই।
অথচ দুদকের প্রাপ্ত রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় নজরুল ইসলাম, স্ত্রী শাহানাজ পারভীন, ভাই তরিকুল ইসলাম, বোন সেলিনা বেগম ও চাচাতো বোন নিলুফা বেগম ও হালিমা বেগমের নামে ৩২টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেন পাওয়া গেছে। এরমধ্যে ৫টি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বরিশাল শাখায় নজরুল ইসলামের নামে ১০টি এফডিআর ও সাতটি সঞ্চয়ী হিসাব নম্বরে লেনদেন হয়েছে ১৪ কোটি ২৫ লাখ ১৫ হাজার ৫৮৭ টাকা।
স্ত্রী শাহানাজ পারভীনের নামে দুটি বেসরকারি ব্যাংকের বরিশাল শাখায় ৬টি এফডিআর অ্যাকাউন্টে লেনদেন হয়েছে ৪ কোটি ১৩ লাখ ৪৬ হাজার ৫৬২ টাকা। ভাই তরিকুল ইসলামের নামে একটি বেসরকারি ব্যাংকের বরিশাল শাখায় সঞ্চয়ী হিসাব নম্বরে লেদেন হয়েছে ৩ কোটি টাকা।
আরেকটি বেসরকারি ব্যাংকের বরিশাল শাখায় বোন সেলিনা বেগম, চাচাতো বোন নিলুফা বেগম ও হালিমা বেগমের নামে সাতটি এফডিআর অ্যাকাউন্টে জমা আছে ৩ কোটি ২ লাখ ৪৫ হাজার ৭০৪ টাকা। গত বছরের ৩০ মে বরিশাল বিশেষ জজ আদালতের আদেশে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এফডিআর করা এ অর্থ অবরুদ্ধ করা আছে।
মামলার তদন্তকালে নজরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী শাহানাজ পারভীনের নামে বিপুল পরিমাণ স্থাবর সম্পদের তথ্যও নিশ্চিত হয়েছে দুদক। মামলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পদ আদালতের নির্দেশে ক্রোক করা হয়েছে। সম্পদ বিবরণী বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিবছরই নজরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী সাফ-কবলা দলিলে জায়গা-জমির মালিক হয়েছেন।
২০১৪ সালের ১৯ মে বরিশালের সদর সাবরেজিস্ট্রি অফিসের সাফ-কবলা দলিলে (নম্বর ৫৪০৩) নিজের নামে ৪ শতাংশ জায়গা কেনেন নজরুল ইসলাম। বগুড়া আলেকান্দা মৌজায় কেনা এই জায়গার দলিল মূল্য দেখানো হয়েছে ২০ লাখ টাকা। ২০১৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর একই মৌজায় সাফ-কবলা দলিলে (নম্বর ১৩৩৯৩) দশমিক ২০ শতাংশ ভূমির মালিক হন তিনি। এই জায়গার দলিল মূল্য দেখানো হয়েছে ১৮ লাখ টাকা।
২০১৭ সালের ১৪ নভেম্বর তিনি একই মৌজায় (দলিল নম্বর ১২৯৩৫) স্ত্রী শাহানাজ পারভীনের নামে ১ দশমিক ১৫ শতাংশ জমি কেনেন। দলিল মূল্য দেখানো হয় ৬ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। ওই মাসেরই ৩০ নভেম্বর (দলিল নম্বর ১৩৭০৭) স্ত্রীর নামে কেনেন তিন তলা ভবনসহ আরও ৬ শতাংশ জমি। যার দলিল মূল্য দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৮ লাখ ৫৫ হাজার টাকা।
তদন্তকালে দুদক নিশ্চিত হয়েছে, ওই তিন তলা ভবনসহ ভূমির মালিক ছিলেন ৫/এ জাকির হোসেন রোড, মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা আমিরুল ইসলাম বান্না। তিনি ১ কোটি ৪০ লাখ টাকায় এই জায়গা বিক্রি করেছেন। জমির দাম বাবদ নজরুল ইসলাম ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর বেসরকারি একটি ব্যাংকের চেকে (নম্বর ৮৪৯১৩২৫) ২৭ লাখ ৩০ হাজার টাকা পরিশোধ করেন। জমির ক্রয়মূল্য ১ কোটি ৪০ লাখ টাকার সঙ্গে রেজিস্ট্রেশন ব্যয় বাবদ আরও ১৫ লাখসহ মোট খরচ দাঁড়ায় ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।
অথচ অবৈধ আয় নিরাপদ করতে আসামি তার আয়কর রিটার্নে রেজিস্ট্রি খরচসহ এই জমির ক্রয়মূল্য দেখান ১ কোটি ১৯ লাখ ৪০ হাজার ৫০০ টাকা। এভাবে দুটি ভবনে তাদের ২ কোটি ৯৯ লাখ ৮৮ হাজার ৪৭২ টাকা বিনিয়োগের তথ্য পাওয়া গেছে। নজরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী শাহানাজ পারভীনের নামে স্থাবর-অস্থাবর ৬ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য নিশ্চিত হয়েছে দুদক।
তদন্তকালে নজরুল ইসলামের বেতন-ভাতা ও আয়কর রিটার্নের সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২৫ বছরের চাকরি জীবনে (১৯৯৮ সালের জুন থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি) আয় করেছেন ৬০ লাখ ৭৮ হাজার ৮০০ টাকা।
নজরুল ইসলাম পলাতক থাকায় তার পারিবারিক ব্যয়ের সুনির্দিষ্ট তথ্য নিশ্চিত হতে পারেননি তদন্তকারী। তবে আয়ের শতকরা ৫০ ভাগ পারিবারিক ব্যয় হিসাবে আসে ৩০ লাখ ৩৯ হাজার ৪০০ টাকা। এছাড়া একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি ঋণ নিয়েছেন ৮১ লাখ ৪৪ হাজার ৮৪২ টাকা। অর্থাৎ মোট সম্পদ থেকে আয় ও দায় বাদ দিলে আসামিদের ৫ কোটি ১৫ হাজার ৯৩৪ টাকার জ্ঞাতআয়বহির্ভূত সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুদক।
আসামিদের অস্থাবর সম্পদের তথ্য বিশ্লেষণ করে তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, নজরুল ইসলামের ভাই তরিকুল ইসলামের নামে বেসরকারি ব্যাংকের বরিশাল শাখায় খোলা হিসাব নম্বরে ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ৯ আগস্ট পর্যন্ত ৩ কোটি ৫৯ হাজার ৭১ টাকা জমা ও সমপরিমাণ টাকা তুলে নেওয়া হয়। যা অস্বাভাবিক। এই টাকা ভোলা ও বরিশালের সড়ক বিভাগের বিভিন্ন ঠিকাদাররা তার হিসাব নম্বরে জমা দেন।
এর মধ্যে ভোলার এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি একটি ব্যাংকের হিসাব নম্বর থেকে ২৩ লাখ টাকা তরিকুল ইসলামের হিসাবে জমা করেন। দুই দফায় ৪৮ লাখ টাকা জমা করে অপর একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তরিকুল ইসলাম নিজে জমা করেন ৪৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এভাবে ৩ কোটি ৫৯ হাজার ৭১ টাকা জমার পর তা নগদ উত্তোলনসহ স্থানান্তর করে নেওয়া হয়েছে।
তদন্তে দেখা গেছে, শুধু ২০১৯ সালেই নজরুল ইসলাম বেসরকারি ব্যাংকের বরিশাল শাখায় নিজের নামে ৫০ লাখ টাকার এফডিআর করেন। আর স্ত্রীর শাহানাজ পারভীনের নামে করেন ২ কোটি ৬০ লাখ টাকার এফডিআর। ২০২০ সালে একই ব্যাংকে স্ত্রীর নামে আরও ৭৮ লাখ ৮০ হাজার টাকার এফডিআর করেন তিনি। কোটি কোটি টাকার এই এফডিআরের পরিসংখ্যান দেখে বিস্ময়ে হতবাক দুদক কর্মকর্তারা বলেছেন, নজরুল ইসলাম হাতে পেয়েছেন টাকার মেশিন।’ তথ্যসূত্র: দৈনিক যুগান্তর পত্রিকা।