বরিশালে স্বল্প আয়ের মানুষের মাঝে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বা ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করছে টিসিবি। তবে কার্ড বিতরণে অনিয়ম এবং স্বজনপ্রীতি করার অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগের সত্যতা খুঁজতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নগরীর ২২নং ওয়ার্ডের সাধারণ মানুষের টিসিবি কার্ড নিয়ে নয়ছয় করছে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। এছাড়াও একজন জনপ্রতিনিধিরও নামও রয়েছে এদের লিস্টে। তবে অভিযোগের বিষয়ে অস্বীকার করে অভিযুক্ত ব্যাক্তিরা বলছেন, যাচাই বাচাই করে কার্ড দেয়া হয়েছে। এদিকে ভুক্তভোগীদের বক্তব্য ভিন্ন।তাদের দাবি,ধনাঢ্য ব্যাক্তিরা টিসিবির কার্ড পেলেও গরীবের ঘরে আসেনা টিসিবির পণ্য ৷ প্রকৃত নামধারি সুবিধাভোগীদের কার্ড না দিয়ে ২শ’ থেকে ১ হাজার টাকার বিনিময়ে অন্যের কাছে টিসিবি কার্ড বিক্রি করেছে তারা। এছাড়াও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং অন্যান্য নেতাকর্মীদের আত্মীয় স্বজনদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে অসংখ্য কার্ড। এমনকি অন্যের নাম কার্ড দিয়ে নিজেরাই বিভিন্ন ডিলারের থেকে পণ্য ছাড়িয়ে নিচ্ছেন তারা। এই ওয়ার্ডে ২ হাজার ৩৭৪টি কার্ডের অনুমোদন দেয় বিসিসি। এর মধ্যে প্রায় নামধারি কার্ডের মালিক প্রাপ্ত টিসিবির পণ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। গত মাসের শেষ সপ্তাহে (২৮ জানুয়ারি) সকালে সরজমিনে ২২নং ওয়ার্ডের বাইতুল মদিনা জামে মসজিদের সামনে গিয়ে দেখা যায় ডিলারের থেকে টিসিবি পণ্য নিতে আসা এলাকার নারী পুরুষ ভীড় করছে। যাদের হাতে থাকা টিসিবি কার্ডের নামের সঙ্গে তাদের নাম ঠিকানার কোনো মিল নেই। টিসিবি’র কার্ডে নাম মিল না থাকা কয়েকজন জানান, অনেকদিন পূর্বে আমাদের থেকে ভোটার আইডির ফটোকপি নেয় স্থানীয় জাকির হাওলাদার ওরফে (বাংলা ভাই)। আইডি কার্ডের ফটোকপি নেয়ার পর কয়েক মাস পার হলেও কার্ডের কোনো খবর না পেয়ে জাকির ভাইকে কার্ডের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে সে বলতো কার্ড আসেনায়। পরে একজনের পরামর্শে তাকে কিছু খরচ দিয়েছিলাম তারপরই অন্য কার নামের যেনো একটা কার্ড আমাকে দিয়ে যায়, সেই কার্ডেরই পণ্য নিতে আসছিলাম।
এদিকে মদিনা মসজিদ এলাকার ভুক্তভোগী সাহানাজ পারভীন বলেন, আমি কতটা কষ্ট করে দিন পাড় করছি তা জেনেও জাকির ভাই আমার টিসিবির কার্ডটা নিয়ে এমন করবে আমি কখনো ভাবিনি। কার্ড দেয়ার কথা বলে সেই কবে আমার ভোটার আইডির ফটোকপি নিছে, কিন্তু সবাই কার্ড পেলেও আমি একটা কার্ড পাইনা। তিনি আরও বলেন, আমার বাসার আশেপাশের যাদের ২/৩ তলা বিল্ডিং আছে তাড়াও কার্ড দিয়ে মালামাল আনে, আর আমার কার্ডের খবর নাই। শুনেছি আমার নামের কার্ড অনেক আগেই অনুমোদন হয়ে আসছে কিন্তু আমাকে কোনো কার্ড দেয়নি তিনি। একই এলাকার দুলাল হাওলাদার জানান, এই এলাকার সবাই যানে আমি কতটা অসহায়ভাবে জীবন যাপন করছি। সরকার আমাদের জন্য টিসিবি কার্ডের মাধ্যমে স্বল্প টাকায় পণ্য দিবে শুনে জাকিরের কাছে ভোতার আইডির ফটোকপি দিয়েছিলাম। আমার আশেপাশের অনেকের কার্ড আসলেও আমার কার্ড পাইনায়। কার্ড না পেয়ে জাকিরের কাছে জিজ্ঞাসা করলে জাকির জানায় ওয়ার্ড সভাপতি মঞ্জু এবিষয়ে বলতে পারবে। পরে মঞ্জুর কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম ,সে বলে আপনার কার্ড আসেনি। এতোদিন তাদের কথা বিশ্বাস করে বসে ছিলাম। কিন্তু কয়েকদিন আগে এরকম একটা বিষয় শোনার পর খোঁজ নিয়ে যানতে পারি আমার কার্ড অনুমোদন হয়ে আসছে অনেক আগেই। সেই কার্ড দিয়ে বহুবার মালামাল উঠানো হহয়েছে। এছাড়াও আরও দেখা যায়, ওয়ার্ডের এক বহিষ্কৃত মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রীর মামা দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিদের উপেক্ষা করে ক্ষমতার দাপটে ৫টি কার্ডের টিসিবির পণ্য তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। তার সাথে কথা বলতে গেলে জানান, আত্মীয় স্বজনের কার্ডের পণ্য একসাথে তুলে নিলাম এই বলেই ডিলারের দোকান থেকে সটকে পড়েন তিনি।
পণ্য নিতে আসা এলাকার শিরীন আক্তার জানান, জাকির ভাইকে একটা কার্ডের কথা বলেছিলাম। সেসময় আমার ভোটার আইডির ফটোকপি দিয়েছিলাম কিন্তু পরে সে আমাকে অন্য একজনের নামের কার্ড আমাকে দেয়।সেই কার্ডের পণ্যই নিতে এসেছি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জানান, শুধু শিরীন নয় এমন আরও অনেকে জাকিরের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে টিসিবির কার্ড নিয়েছে। কিন্তু কার্ডের সাথে তাদের নামের মিল নেই। সকল অভিযোগ অস্বীকার করে অভিযুক্ত জাকির হাওলাদার ওরফে (বাংলা ভাই) বলেন,আমি যাদের থেকে আইডি কার্ডের ফটোকপি নিয়েছি সকলকেই কার্ড দেয়ার চেষ্টা করেছি। কোনো ধরনের স্বজনপ্রীতি আমি করিনি।ওয়ার্ড সভাপতি মঞ্জু ভাই আমার কাছে যেই কয়টা কার্ড দিয়েছে আমি সেই কয়টাই সবাইকে দিয়ে দিছি। বিসিসি থেকে কয়টা কার্ডের অনুমোদন দিয়েছে সেই লিস্ট তো আমার কাছে নাই। ওগুলো মঞ্জু ভাই যানে। যদি কিছু হয়ে থাকে তা মঞ্জু ভাই ভালো যানে। এবিষয়ে অভিযুক্ত ২২ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মঞ্জুর মোর্শেদ জানান, টিসিবির কার্ড আমি একা বন্টন করিনি। ওয়ার্ড কাউন্সিলর, সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার মাধ্যমে কার্ড বিতরণ করা হয়েছে। আমি যেই কার্ডগুলো বিতরণ করেছি তাতে কোনো অনিয়ম বা স্বজনপ্রীতি হয়নি। তিনি আরও বলেন,ভুক্তভোগী যারা অভিযোগ করেছেন তারা হয়তো একের অধিক লোকের কাছে কার্ড পাওয়ার আশায় ভোটার আইডির ফটোকপি জমা দিয়েছিলেন। আর এ কারণে কার মাধ্যমে তাদের কার্ড অনুমোদন হয়ে এসেছে সঠিকভাবে বলা সম্ভব হচ্ছেনা ৷
এবিষয়ে বরিশাল সিটি কর্পোরেশন বিসিসি’র মেয়র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত ওমরাহ হজ্জের জন্য দেশের বাইরে থাকায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি৷ তবে বিসিসি’র উর্ধতন কতৃপক্ষ বলেন,এবিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
উল্লেখ্য,দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বরিশাল-৫ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সালাহউদ্দিন রিপনের পক্ষে ভোট চেয়ে টাকা বিতরণের সময় ২২নং ওয়ার্ড সভাপতি মঞ্জুর মোর্শেদকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয় নৌকার প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা। পরে তাকে ১৫ দিনের কারাদণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠায় ভ্রাম্যমাণ আদালত।