দক্ষিণবঙ্গের আ.লীগের রাজনীতি : বরিশাল বিভাগে পরিচালনায় প্রাধান্য প্রবীণ নেতৃবন্দ
মহানগর ও ৬টি জেলা নিয়ে বরিশাল বিভাগ সাজিয়েছে আওয়ামী লীগ। গ্রুপিং-দ্বন্দ্ব ও নিজস্ব বলয়ে চলছে বরিশালে দলটির রাজনীতি। এ বিভাগের দুটি জেলা বাদে কোনো জেলায় আওয়ামী লীগের কমিটির মেয়াদ নেই। একই অবস্থা সহযোগী সংগঠনগুলোরও। মহানগর ও বরিশাল জেলার দলীয় রাজনীতির বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর পরিবার। ঝালকাঠি এবং ভোলা জেলা আওয়ামী লীগে একচ্ছত্র বলয় রয়েছে দেশের বর্ষীয়ান দুই নেতা আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদের। আর শীর্ষ নেতাদের গ্রুপিং ও বলয়ের প্রভাবে বিভক্ত দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা।
বরিশালের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৃহত্তর বরিশাল আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দুটি বলয় ছিল। একটি আমির হোসেন আমুর অপরটি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর। অন্যদিকে বর্তমানে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক বরাবরই আমির হোসেন আমুর অনুসারী হিসেবে বরিশালে পরিচিত। একসময় আমু ও হাসানাতের বাইরেও বৃহত্তর বরিশালে তোফায়েল আহমেদের একটি বলয় ছিল। তবে দীর্ঘ সময় ধরে রাজনীতিতে অনুপস্থিত ও অসুস্থতার কারণে তোফায়েলের বলয় কমে এখন শুধু ভোলা জেলায় সীমাবদ্ধ।গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে নির্বাচিত হওয়া এমপিদের বড় অংশ আমু ও নানকের অনুসারী। তারা আবার আবুল হাসানাত বিরোধীও।
বরিশাল বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন প্রতিবেদক কে বলেন, দলের সব পর্যায়ের নেতাদের ঐক্যবদ্ধ করে, কোথাও কোনো সমস্যা বা ভুল-বোঝাবুঝি থাকলে সমাধানের চেষ্টা চালানো হবে। স্থানীয় পর্যায়ে দলের মধ্যে কোনো কাদা ছোড়াছুড়ি করা যাবে না, আমাদের নেত্রীর নির্দেশ রয়েছে। কারও সঙ্গে কারও সমস্যা থাকলে নেতাদের ঢাকায় ডেকে সমাধানের চেষ্টা করা হবে।
সাংগঠনিক বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের জেলা ও মহানগরের সম্মেলন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। পিরোজপুর ও বরগুনা জেলা ছাড়া বাকি জেলাগুলোর কমিটির মেয়াদ শেষ। এর মধ্যে বরিশাল জেলার মেয়াদ শেষ হয়েছে বহু আগে। জাতীয় নির্বাচন যেহেতু শেষ হয়েছে, আমরা নেত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে সম্মেলনের প্রক্রিয়া শুরু করব।’
মহানগর ও বরিশাল জেলা
মহানগর ও জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর পরিবার । দুই দশকের বেশি সময় ধরে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগে একক নিয়ন্ত্রণের রেখেছেন দলের কেন্দ্রীয় সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। প্রতিটি উপজেলায় মূল দল ও সহযোগী সংগঠনের রাজনীতি তিনিই দেখভাল করছেন। এর পাশাপাশি পিরোজপুর, বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলার রাজনীতিতেও তিনি অনুসারীদের পদে রেখেছেন।
বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগে অভ্যন্তরীণ কোন্দল রয়েছে কয়েক যুগ ধরে। তবে বরিশাল মহানগরের রাজনীতিতে ভিন্নতা এসেছে সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের পর। বিশেষ করে প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরণ মারা যাওয়ার পর নগরের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। তবে সর্বশেষ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দল সাদিককে মনোনয়ন না দিয়ে তার চাচা আবুল খায়ের আব্দগল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত কে নৌকার মনোনয়ন দেয়। মেয়র নির্বাচিত হন খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত । হাসানাত পরিবারের সঙ্গে আবুল খায়েরের বৈরী সম্পর্ক বহু বছরের। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আবুল খায়েরকে ঘিরে বরিশাল আওয়ামী লীগে তৈরি হয়েছে নতুন বলয়। তার সঙ্গে যোগ দেয় প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরণের অনুসারীরা। গেল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশাল ৫ আসনে পুনরায় নৌকার মনোনয়ন পান বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগ এর সহ সভাপতি কর্নেল (অবঃ) জাহিদ ফারুক শামীম। মনোনয়ন না পেয়ে এই আসনে লীয় সভানেত্রী’র সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ান হাসনাত পুত্র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ। তবে তার প্রার্থিতা বাতিল হলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহিদ ফারুক কে যেকোনো উপায় ঠেকাতে দলীয় পদ পদবী ব্যবহার করে প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নৌকার বিরোধিতা করেও ব্যর্থ হয় হাসানাত পুত্র সাদিক আব্দুল্লাহর সহ তাদের অনুসারীদের কূটকৌশল।
দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা র বরিশালের নির্বাচনী জনসভায় সততা ও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করে আসার কথা নিজ মূখে প্রশংসা করে জাহিদ ফারুক কে পুনরায় নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে বিজয়ী করার আহবান জানান। এরপরেও ক্লিন ইমেজের নেতা হিসেবে সুপরিচিত জাহিদ ফারুক শামীম কে বিভিন্ন ভাবে কোনঠাসা করে রাখার প্রচেষ্টাও ব্যার্থ হয়ে বিপুল ভোটে দ্বিতীয় বারের মতো নৌকা প্রতিক নিয়ে নির্বাচিত হন কর্নেল (অবঃ) জাহিদ ফারুক শামীম। তার সঙ্গে আবার সাদিকের চাচা মেয়র খায়েরের সম্পর্ক বেশ ভালো। এতে নগরের রাজনীতিতে এক অংশের নিয়ন্ত্রণ হারান আবুল হাসানাত পরিবার। এ নিয়ে দলের সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও কয়েক ভাগে বিভক্ত। যদিও জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের সঙ্গে সহযোগী সংগঠনগুলোর কোনো কমিটির মেয়াদ নেই।
মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি কে এম জাহাঙ্গীর বলেন, নির্বাচনের আগে দলে বিভাজন ছিল। এখন সব ঠিক হয়ে যাবে। রাজনীতি করতে গেলে অনেক কিছু হয়। আবার সবাইকে নিয়ে চলতেও হয়। মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি কেউ ভাঙতে পারবে না।
তবে অতিদ্রুত মহানগর কমিটির বিলুপ্তি চান নগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি এ্যাডঃ আফজালুল করিম। তিনি বলেন, বর্তমানে মহানগর কমিটির শীর্ষ পদে যারা আছেন তারা আদর্শের জায়গায় নেই। তারা ব্যক্তিস্বার্থ নিয়ে আছেন। সংগঠনের দিকে তাদের কোনো মনোযোগ নেই। এই কমিটির মেয়াদও শেষ। তাই বরিশাল মহানগরের কমিটি বাদ নিয়ে একটি আহ্বায়ক কমিটি করা এখন নৈতিক দায়িত্ব। আমরা দলের সভাগুলোতেও প্রকাশ্যে নতুন কমিটির দাবি জানিয়েছি।
ঝালকাঠি জেলা
জেলা এবং উপজেলাগুলোর আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর কমিটির মেয়াদ নেই। এই জেলার দলীয় নেতাদের বড় অংশ বর্ষীয়ান নেতা ও ঝালকাঠি-২ আসনের এমপি আমির হোসেন আমুর অনুসারী। এককেন্দ্রিক রাজনীতি চলে এই জেলায়, তাই দলীয় গ্রুপিং অনেক কম। এই জেলায় সরকারি টেন্ডার ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন চার নেতা। স্থানীয় ভাষায় তাদের ৪ খলিফা বলা হয়। এর মধ্যে রয়েছেন, ২০১২ সালে থেকে জেলা যুবলীগের আহ্বায়কের দায়িত্বে থাকা রেজাউল করীম জাকির। সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর কাউন্সিলর হাফিজ আল মাহমুদ। জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুরুল আমিন সুরুজ ও জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক কামাল শরিফ। এই চার নেতার বিরুদ্ধে স্থানীয় পর্যায়ে সাধারণ মানুষের অভিযোগের শেষ নেই।
ভোলা জেলা
জেলার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদ ও তার ছেলে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মইনুল হোসেন বিপ্লব। সরকারের কাজ ও স্থানীয় পর্যায়ের সব বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণও বিপ্লবের হাতে। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুল কাদের মজনু মোল্লার সঙ্গে তোফায়েল পরিবারের বৈরী সম্পর্ক। তাই জেলার রাজনীতিতে তিনি অনেকটা কোণঠাসা হয়ে আছেন। এই জেলা আওয়ামী লীগের কমিটির মেয়াদ রয়েছে। তবে দলের সাংগঠনিক কোনো সভা বা কর্মিসভা হয় না এই জেলায়। এর জন্য তোফায়েল আহমেদের প্রভাবকে দায়ী করছেন স্থানীয় নেতারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ এক নেতা বলেন, এখানে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ করেন কেন্দ্রীয় এক মুরব্বি। সহযোগী সংগঠনের মধ্যে যেখানে মুরব্বির আত্মীয়স্বজন রয়েছে সেগুলোর সম্মেলন হতে দেওয়া হয় না। জেলা আওয়ামী লীগে তার প্রভাবে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও বিএনপি-জামায়াতের লোকদের পদ দেওয়া হয়েছে। সভাপতি কিছু বললেও কাজ হয় না।
জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুল কাদের মজনু বলেন, ‘সমন্বয়ের বড়ই অভাব। আমি জেলার সাধারণ সম্পাদককে একটি মিটিং বা সভায় ঢাকলে তিনি আসেন না। এভাবে চলছে আমাদের রাজনীতি।’ এর বেশি কিছু তিনি বলতে রাজি হননি মজনু।
বরগুনা জেলা
প্রায় ৪০ বছর ধরে বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে ধীরেন্দ্র দেবনাথ (শম্ভু) ও সাধারণ সম্পাদক পদে জাহাঙ্গীর কবির রয়েছেন। দলের সহযোগী সংগঠনের মধ্যে স্বেচ্ছাসেবক লীগ ছাড়া কোনো সংগঠনের কমিটির মেয়াদ নেই। জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতি চলছে তিন নেতার বলয়ের মাধ্যমে। গত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন পেয়েও ধীরেন্দ্র দেবনাথ স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম সরোয়ার টুকুর কাছে পরাজিত হন। বর্তমান এমপি টুকুকে ঘিরে জেলায় নতুন গ্রুপিং শুরু হয়। আগে থেকে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে দুটি গ্রুপ ছিল। এই তিন গ্রুপের প্রভাবে জেলা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও তিন গ্রুপে বিভক্ত। তবে কেউ দায় স্বীকার করেন না।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির বলেন, ‘এখানে সব ঠিক আছে। অন্য জেলা আওয়ামী লীগের যে অবস্থা এখানেও সেই অবস্থা।’
পটুয়াখালী জেলা
২০১৯ সালে সম্মেলন হওয়ায় এই জেলার বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী আলমগীর হোসেনকে কেন্দ্র করে চলে এই জেলার রাজনীতি। জেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও দুই ভাগে বিভক্ত। সরকারি কাজও নিয়ন্ত্রণ করেন দুই গ্রুপের নেতারা। যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ ছাড়া কোনো সংগঠনের কমিটির মেয়াদ নেই। উপজেলাগুলোর কমিটির মেয়াদও শেষ। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে এই জেলায় রাজনীতিতে আফজাল হোসেন ও কাজী আলমগীর হোসেনের অনুসারীরা প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন।
পিরোজপুর জেলা
জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ দুই নেতার হাতে। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম এ আউয়াল ও সদস্য শ ম রেজাউল করিমের দ্বন্দ্বের কারণে দলের সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও এখন বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পিরোজপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন রেজাউল করিম। দলীয় মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আউয়াল স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও পরাজিত হন। জেলার সরকারি টেন্ডারগুলো এখন পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করছেন সাবেক মন্ত্রী রেজাউল। নির্বাচনের পরে অনেকটা কোণঠাসা আউয়ালের সমর্থকরা। এই জেলা আওয়ামী লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ কমিটির মেয়াদ রয়েছে। বাকি সংগঠনের কমিটির মেয়াদ নেই।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আউয়াল বলেন, এখানে দলের অবস্থা ভালো। তবে এমপির জামাতা বিএনপির লোক নিয়ে চলেন। দলের নেতাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ আগেও রাখেননি। এখনো দলের নেতারা তার কাছ থেকে কোনো সুযোগ-সুবিধা পান না।