বিএনপির গঠনতন্ত্রের ১৫ ধরার বিশেষ বিধান ‘এক নেতার এক পদ’ যুক্ত করা হয়েছে ২০১৬ সালের ১৯ মার্চের কাউন্সিলে। সিদ্ধান্ত হয়েছিল গঠনতন্ত্রের ১৫-এর ‘ক’ ও ‘খ’ উপধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি একই সঙ্গে দলের কোনো পর্যায়ের কমিটির দুই পদে থাকতে পারবেন না। কিন্তু গত আট বছরেও কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে সেই বিধান বাস্তবায়ন হয়নি বরিশাল বিএনপিতে। এমনকি সর্বশেষ ঘোষণা হওয়া মহানগর বিএনপির পূর্ণাঙ্গ আহবায়ক কমিটিতেও লঙ্ঘন হয়েছে গঠনতন্ত্র।
দলীয় সূত্র বলছে, বিএনপির ওয়ার্ড এবং অঙ্গ সংগঠনের পদে থাকা নেতারাও পেয়েছেন মহানগর বিএনপির পদ। এমনকি জেলা বিএনপির নেতাকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে মহানগরে। তার ওপর কমিটির সর্বোচ্চ বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল আলম ফরিদকেও করা হয়েছে অবমূল্যায়ন। এসব কারণে প্রতিবাদ সরূপ গতকাল মহানগর বিএনপির প্রথম পরিচিতি সভা বর্জন করেছেন কমিটির যুগ্ম আহবায়কসহ ১৩ জন সদস্য।
দিও মহানগর কমিটির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন সংগঠনের অপর একটি অংশ। এমনকি পূর্ণাঙ্গা আহবায়ক কমিটি ঘোষণা করায় তারা আনন্দ মিছিল এবং মিষ্টি বিতরণও করেছেন।
এর আগে গত ৪ নভেম্বর মনিরুজ্জামান ফারুককে আহবায়ক, জিয়াউদ্দিন সিকদারকে সদস্য সচিব ও আফরোজা খানম নাসরিনকে ১ নম্বর যুগ্ম আহবায়ক রেখে ঘোষণা করা হয় বরিশাল মহানগর বিএনপির ৪২ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ আহবায়ক কমিটি।
নবগঠিত এ কমিটিতে সর্বোচ্চ বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা নূরুল আলম ফরিদ। বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে ভূমিকা রেখে আসছেন নূরুল আলম ফরিদ। আন্দোলন-সংগ্রামেও ছিলেন তিনি। এজন্য আওয়ামী সরকারের গত প্রায় ১৬ বছরে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে তাকে।
অথচ প্রবীণ এই নেতাকেই অবমূল্যায়ন করা হয়েছে মহানগর বিএনপির নবগঠিত কমিটিতে। তাকে আহবায়ক কমিটির দুই নম্বর সদস্য মনোনীত করা হয়েছে। তবে বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, এ কমিটির ১ নম্বর সদস্য করা হয়েছে তারই ভাগ্নে ওয়ায়ের ইবনে গোলাম কাদিরকে।
অপরদিকে জ্যেষ্ঠ নেতাদের পাশকাটিয়ে কমিটি গঠনের পাশাপাশি গঠনতন্ত্রের ‘এক নেতার এক পদ’ বিধান লঙ্ঘন করে ওয়ার্ড বিএনপির আহবায়কসহ ১৩ জনকে দ্বৈত পদ দেওয়া হয়েছে মহানগর বিএনপিতে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মহানগর বিএনপির কমিটিতে ২৭ নম্বর সদস্য করা হয়েছে বরিশাল দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটির ৪৭ নম্বর সদস্য মো. সোহেল সিকদারকে। ইতিপূর্বে বাকেরগঞ্জ উপজেলার নেয়ামতি ইউনিয়ন বিএনপির সদস্য সচিব ছিলেন তিনি।
এছাড়া মহানগর বিএনপির ২০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির আহবায়ক মাহফুজুর রহমান মাহফুজ এবং ২৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির আহবায়ক সাজ্জাদ হোসেনকে দেওয়া হয়েছে যুগ্ম আহবায়কের পদ। ৪ নম্বর ওয়ার্ডের আহবায়ক আসাদুজ্জামান মারুফকে দেওয়া হয়েছে মহানগর বিএনপির আহবায়ক কমিটির সদস্য পদ। মহানগর যুবদলের সহ-সভাপতি পদেও রয়েছেন মারুফ। এছাড়া আরো ৭টি ওয়ার্ড বিএনপির আরো সাতজন আহবায়ককে সদস্য করা হয়েছে।
এর বাইরে জেলা যুবদলের সহ-সভাপতি খাইরুল আলম তপনকেও মহানগর বিএনপির সদস্য করা হয়েছে। সদস্য পদ পেয়েছেন মহানগর মহিলা দলের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট সুফিয়া আক্তার ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাসিনা কামাল।
অভিযোগ রয়েছে, নবগঠিত কমিটিতে মাদক মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকেও যুগ্ম আহবায়কের পদ দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মামলাটি এখন উচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। আগের আহবায়ক কমিটির ৪০ নম্বর সদস্য জসিম উদ্দিনকে করা হয়েছে বর্তমান কমিটির দুই নম্বর যুগ্ম আহবায়ক।
তাছাড়া সদস্য পদ পাওয়া একেএম মিজানুর রহমান ইতিপূর্বে চট্টগ্রামে পিডিবির প্রকৌশলী ছিলেন। কোনো কালেই তিনি বিএনপির রাজনীতিতে ছিলেন না বলে দাবি করেছেন দলের বঞ্চিত নেতারা। একইভাবে কমিটির সর্বশেষ সদস্য নুরুল ইসলাম পানিরও মহানগর বিএনপির কমিটিতে উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন বলে দাবি তাদের।
যানা যায়, মঙ্গলবার বরিশাল মহানগর বিএনপির নবগঠিত পূর্ণাঙ্গ আহবায়ক কমিটির পরিচিতি সভা ছিল। বেলা সাড়ে ১১টায় সদর রোডে বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় অংশগ্রহণ করেননি নবগঠিত কমিটির যুগ্ম আহবায়কসহ ১৩ জন সদস্য।
অংশগ্রহণ না করা নেতারা হলেন- যুগ্ম আহবায়ক আবুল কালাম আজাদ, সদস্য অ্যাডভোকেট কাজী বশির, অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির মাসুদ, অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ ইমন, অ্যাডভোকেট সরোয়ার হোসেন, অ্যাডভোকেট তসলিম, আরিফুর রহমান বাবু, জাহিদুর রহমান রিপন, সাইফল আনাম বিপু, জুলহাস উদ্দিন মাসুদ, মাসুদ হাওলাদার, অ্যাডভোকেট সাঈদ খোকনসহ ১৩ জন।
কমিটির প্রথম সভায় অংশগ্রহণ না করা প্রসঙ্গে মহানগর বিএনপির আহবায়ক কমিটির সদস্য আরিফুর রহমান বাবু বলেন, ‘এটা কোনো কমিটিই হয়নি, এটা হয়েছে মাই ম্যানের কমিটি’। যাদের কমিটিতে রাখা হয়েছে তাদের কী যোগ্যতা আছে মহানগরের মত একটি ইউনিট কমিটিতে আসার।
তিনি বলেন, ‘নবগঠিত কমিটিতে জ্যেষ্ঠদের অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। অনেকে পদ পেয়েছেন যারা কখনই বরিশালের রাজনীতিতে ছিলেন। কমিটির ৩৬ নম্বর সদস্য একেএম মিজানুর রহমান কোথায় রাজনীতি করেছেন তা হয়তো তিনি নিজেই বলতে পারবেন না। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে ভুল বুঝিয়ে একটি ভুয়া কমিটি করা হয়েছে। তাই প্রতিবাদ সরূপ আমরা নবগঠিত কমিটির প্রথম সভা বয়কট করেছি।
এক প্রশ্নের জবাবে আরিফুর রহমান বাবু বলেন, কমিটি ঘোষণার আগে বিষয়টি আমরা জানতাম না। ঘোষণার পর বিষয়টি সামনে এসেছে। বিষয়টি আমরা কেন্দ্রে অবহিত করবো। এরপর পদত্যাগ করবো কিনা সে বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হবে।
এদিকে বিএনপি পদবঞ্চিত নেতৃবৃন্দ বলছেন, মহানগর বিএনপির আহবায়ক এবং সদস্য সচিব নিজেদের মত করে কমিটি সাজিয়ে কেন্দ্রে জমা দিয়েছেন। তারা তাদের ঘনিষ্ঠ লোকদের নিয়ে কমিটি করেছে। বঞ্চিত নেতাকর্মীদের এমন অভিযোগের কিছুটা প্রমাণ মিলেছে মহানগর বিএনপির আহবায়ক মনিরুজ্জামান ফারুকের বক্তব্যে।
দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য সোহেল সিকদারকে মহানগরের সদস্য করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সোহেল সিকদার সদস্য সচিব জিয়াউদ্দিন সিকদারের ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় তিনি তাকে রেখেছেন। তবে আমি বলে দিয়েছি দুই কমিটির একটি পদ তাকে ছেড়ে দিতে হবে।
তবে বিষয়গুলোকে ছোট্ট করে দেখে মহানগর বিএনপির ৪২ সদস্য বিশিষ্ট আহবায়ক কমিটি অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য হয়েছে বলে দাবি করেছেন মনিরুজ্জামান ফারুক। তবে সিনিয়রিটি মেনটেইন না করার বিষয়টি দুঃখজনক মন্তব্য করে বলেন, আর এ সমস্যা কেন্দ্র থেকেই হয়েছে।
কারণ আফরোজা খানম নাসরিন নগর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক হওয়ায় তার পরে সিনিয়ররা যুগ্ম আহবায়ক হিসেবে থাকতে চাচ্ছেন না। এ কারণে সিনিয়র জুনিয়রের সম্মিলনে কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের পদ পাওয়ার বিষয়ে দলীয় চেয়ারম্যানের নির্দেশনা রয়েছে বলেন তিনি।
মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব জিয়াউদ্দিন সিকদার বলেন, সোহেল সিকদার ইতিপূর্বে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য ছিলেন। তবে তিনি কমিটি ঘোষণার আগেই সেই পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। দলের বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমানের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন।
ওয়ার্ড বিএনপির নেতাদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি গঠনতন্ত্র বিরোধী নয় দাবি করে তিনি বলেন, আগামী ১৬ নভেম্বর বরিশালে আমাদের মহাসমাবেশ রয়েছে। সেই সমাবেশের পর আমরা ওয়ার্ড কমিটিগুলো বিলুপ্ত করার উদ্যোগ নেবো। এখন যারা মহানগর কমিটিতে রয়েছে তাদের ওয়ার্ড কমিটিতে রাখা হবে না।
উল্লেখ্য, গত বছরের ৫ নভেম্বর ঘোষণা করা হয় ৩ সদস্য বিশিষ্ট বরিশাল মহানগর বিএনপির আহবায়ক কমিটি। প্রায় এক বছর পর ওই আহবায়ক কমিটি ৪২ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি পেল।