১০ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ রাত ৮:০৫

একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি লেখক: মনদীপ ঘরাই

মনদীপ ঘরাই
  • আপডেট সময়ঃ মঙ্গলবার, এপ্রিল ১১, ২০২৩,
  • 118 পঠিত

কায়সার,
চিঠির শুরুতে নাম ছাড়া আর কোনো সম্বোধন দিলাম না ইচ্ছে করেই। হঠাৎ চিঠি পেয়ে নিশ্চয়ই অবাক হয়েছো? চিঠির শেষে তোমার যেতেই হবে, তাই না। যাও , যেয়ে দেখে এসো। আমি ছাড়া তোমাকে আর এভাবে চিঠি লেখার মানুষ জীবনে তৈরি করতে পেরেছো?
কত ছোট ছিলাম যখন তোমায় প্রথম দেখি। আমিই তো সাহস করে -কী যেনো লোকটার নাম… ওই দোকানটার পেছনে যেয়ে তোমার সাথে কথা বলেছিলাম। তোমার মনে আছে, আমার মুখে রং ছিলো, শুধু আমার চোখ দেখে তুমি ভালোবেসেছিলে! আচ্ছা, যে চোখ দেখে এত গভীরভাবে ভালোবাসলে, সেই চোখ দিয়েই কেনো এত জল ঝরালে?
আমি জানতাম সবটা। তোমার মায়ের চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে রুবা নামের মেয়েটাকে বিয়ে করেছিলে। ‘বিয়ে করেছিলে’ কথাটা লিখতে গিয়ে হাত আটকে আসছে আজও! এত বছর বছর পর। আসলে, আমার কায়সার অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারে, তা আমার ভাবনাতেও ছিলো না। অনেক অনেক দিন কেঁদেছি। শুধু কেঁদেছি। কাছের কেউ মারা গেলেও তো একসময় চোখের জল শুকিয়ে যায়, আমারও গিয়েছিলো। আমি কাঁদতে ভুলে গিয়েছিলাম। আমার বাবা-মা যখন মারা গেলেন, তখনও আমি কাঁদতে পারিনি। কষ্টে পাথর হয়ে ছিলাম। বাবার কথা মনে পড়ে? তোমাদের প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন আমার বাবা। শেষ যেদিন আমাদের দেখা হয়, আমি বাবার একটা আচরণের কথা তোমাকে বলেছিলাম। মনে পড়ে? বাবা আমাদের বিয়েতে রাজি ছিলেন না। কতটা চিন্তা আর ভয় নিয়ে সেদিন তোমার কাছে গিয়েছিলাম উপায় খুঁজতে! তুমি তখন অনেক বড় দুশ্চিন্তায় ছিলে, জানি। কিন্তু, আমার বয়সটাও তো চিন্তা করবে। আমি কি অতকিছু বুঝতাম? সবচেয়ে অবাক করা বিষয় কি জানো? তুমি যেদিন বিয়ে করে ফেললে, সে রাতে বাবা আমার কান্না দেখে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, মা রে, তুই ছাড়া আমার আর কে আছে বল? তুই যেখানে চাস সেখানেই তোর বিয়ে দেবো। তুই শুধু কান্না করিস না। আমার কান্না আরো বেড়ে গিয়েছিলো কায়সার। অনেক অনেক গুণে বেড়ে গিয়েছিলো। আমি অষ্ফুট স্বরে শুধু বলেছিলাম, “বাবা, ও আজ রাতেই বিয়ে করে ফেলেছে” । বাবা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। আজীবন চেষ্টা করে গেছেন আমাকে তোমার চেয়ে ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিতে। আমার তো ভালো ছেলে দরকার ছিলো না কায়সার। আমার তোমাকে দরকার ছিলো। স্বপ্ন তো আমি তোমাকে নিয়ে দেখেছিলাম। আমি মানুষটার অনেক সীমাবদ্ধতা। আমার সবচেয়ে সম্ভাবনা ছিলে তুমি; আবার সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতাও।আমি তোমার আঁকা অদৃশ্য সীমা অতিক্রম করে অন্য কারো কাছে যেতে পারিনি। অন্য কারো ঘর করতে পারিনি। তোমাকে করতে হয়েছে। আচ্ছা, তুমি কি আমাকে ছাড়া ঘর করেছিলে, সংসার করেছিলে? করেছিলে তো অবশ্যই। সবকিছুই তো আর বাধ্যবাধকতা না।
তোমার ছেলেটার জন্য খুব কষ্ট হতো। মনে হতো ওকে তো আমি মানুষ করলেই পারি। আবার ভাবতাম, আমাকে তো তুমি ডাকো নি। অনেকসময়ই মনে হতো, তুমি আমাকে ভুলেই ছিলে পুরোটা সময়। বছরের পর বছর। ভুল ভেঙ্গেছে । সত্যিই জানো, আমার ভুল ভেঙ্গেছে। কখন জানো তো? যখন তোমার নাতনীটার জন্ম হলো। তুমি নাম রাখলে “পদ্ম”। এই নামটা আমাদের ঠিক করা । আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমাদের মেয়ের নাম রাখবো পদ্ম। তুমি ভোলো নি। তখন বুঝতে পেরেছি, আমি তোমার মনে ঠিক ততটাই আছি, যতটা প্রথম দিন ছিলাম। আমার কোনো ঘর হয়নি। সংসার হয়নি। বাবার রিটায়ারমেন্ট এর পর বাবা-মাকে দেখাশোনা করে কাটিয়েছি বহু বছর। এত এত বছরে এক দিনও কি সাজগোজ করিনি? হাসি নি? ভালো কিছু খাই নি? সব করেছি । সব । শুধু বাঁচার মতো বাঁচতে পারিনি। পড়াশোনা শেষ করে বাবার মতো শিক্ষকতা পেশা বেছে নিয়েছিলাম।আমার বাবা নয় । তোমার বাবার মতো। স্কুল শিক্ষক। শুধু একবার আমার বাবাকে যোগদানের পর জিজ্ঞেস করেছিলাম, আচ্ছা বাবা, তোমার মেয়েও তো এখন স্কুল শিক্ষক। কায়সারের বাবার মতো। আমারও কি সামাজিক মর্যাদা তোমার চোখে কমে গেলো? বাবা, কেঁদেছিলেন সেদিন। ওই প্রথমবার বাবার চোখে জল দেখেছিলাম আমি। আমার শাড়ির প্রতিটা ভাঁজে ভাঁজে তুমি ছিলে কায়সার। হাতের প্রতিটা রেখায় তোমার ছোঁয়া ছিলো। পুরো আমিটাতেই তুমি মিশে ছিলে। এখনও আছো। পরিস্থিতি তোমাকে এক অন্য মানুষে পরিণত করেছে। পরিস্থিতি তোমাকে ‘অন্যের’ মানুষে পরিণত করেছে। আমি তোমারই রয়ে গেছি। কেমন জানো তো? পুরাতন ভাঙ্গাচোড়া জমিদার বাড়ির মতো। যার সিংহদুয়ারের ভাঙ্গা অংশে জমিদারের নাম পাথরে খোদাই করে লেখা আছে। আমার নিশ্চয়ই তোমার মতো বিবেচক মানুষকে আর বলে বোঝাতে হবে না সবকিছু…বুঝে নিও।
একদম শৈশবে মানুষ শরীর চেনে না। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের চোখে শরীর ব্যাপারটা তীক্ষ্ণ হয়ে ধরা দেয়। আমার যখন শরীর ছিলো, আমার পুরোটা জুড়ে তুমি ছিলে। এত যত্ন করে শরীর মন বাঁচিয়ে রেখেছিলাম তোমার জন্য। অলীক এক আশা ঘিরে থাকতো সবসময়- সব হিসেব নিকেষ উল্টে পাল্টে দিয়ে তুমি হয়তো আসবে। তোমার ফুলের শরীরের সুঘ্রানও আর পাঁচটা ফুলের মতো ফুরিয়ে গেছে একসময়। ঝরে গেছে একে একে সব পাপড়ি। তখনও বদল হয়নি কিছু। বুঝে গেছি বছর বছর ধরে, ভালোবাসতে শরীর লাগে না। একদম না।
আমি বাঁচি না বহুদিন। বাবা মায়ের মৃত্যুর পর তো আর ও না। আমিও রিটায়ার করলাম কতদিন হয়ে গেলো। এরপর বাড়িঘর সব বিক্রি করে একটা বৃদ্ধাশ্রমে উঠলাম। এখানে আমার অনেক সঙ্গী হলো। অনেকের অনেক কষ্টের কথা শুনি রোজ। কারও ছেলে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। কেউ নিঃসন্তান, কারো বাসায় দেখার মতো কেউ নেই। আর আমার? আমার শুধু তুমি হারিয়ে গেছো। হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে হারানো একটা কানের দুলের মতো। অন্য কেউ হয়তো সেই দুল পেয়ে বিক্রি করে দিয়েছে, তবে জোড়া মেলাতে পারেনি। পারবেও না কখনো। এখানে সবাই তোমার নাম জানে। সবাই তোমার গল্প জানে। কেউ তোমাকে ভুল বোঝে না। আমি ভুল বুঝতে দেই নি। তোমার বিয়ের কথাও বলিনি। মিথ্যে বলেছি। বলেছি পরিবারের চাপে আমাকে বিয়ে করতে পারেনি। এখন একাই আছে। কিছু মিথ্যে বললে তেমন ক্ষতি নেই। আমি আমার অন্তরের মানুষটাকে আর যাই হোক, বাইরের মানুষের কাছে ছোটো তো করতে পারি না। আমি জানি, তুমি হলেও তাই করতে।
আমার অনেক সময় মন চাইতো কেউ আমাকে একটা শাড়ি কিনে দিক, জোর করে ভ্যানিটি ব্যাগে হাতখরচ গুঁজে দিক। জ্বরের সময় কেউ থার্মোমিটারের তোয়াক্কা না করে বলুক, গায়ে তো বেশ জ্বর; আমার বুকে আসো। তুমি বলবে সেই অপেক্ষাতে থেকে গেছি আজীবন। বলার মতো কাউকে তৈরি করিনি কায়সার।
তুমি তো আমার কাছ থেকে হারিয়েই গেলে। আমি কি আর সেই ভুল করতে পারি বলো? তোমাকে হারাতে দেবা না বলে , আমার স্বত্বা থেকে আলাদা হতে দেবো না বলে, এখানে মানে এই বৃদ্ধাশ্রমে আমাদের মতো বৃদ্ধ মানুষগুলোর জন্য কায়সার-ফুল চিকিৎসা তহবিল নামে একটা ফান্ড গঠন করেছি। আমার সারাজীবনের সঞ্চয় এখানে দান করে দিয়েছি। অনেক টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করা আছে। প্রায় চল্লিশ লাখ। বাবার বাড়ি বিক্রির টাকাও আছে। আমাদের চার দেয়ালের সংসার না হোক; জীবনে আর যুক্ত হওয়া না হোক, একটা জায়গায় আমাদের দুজনের নাম একসাথে থাকুক। তুমি না চাইলেও তোমার নামটা সামান্য একটা জায়গায় ধরে নাও জোর করে দখল করে নিলাম।
আমি জানি, আমাদের দেখা হলে তুমি প্রথম প্রশ্নটাই করতে, “কেমন আছো ফুল?”
তুমি চলে যাওয়ার পরে আমার মনটা তো ভালো ছিলোই না, এখন শরীরটাও আর আগের মতো ভালো নেই। তার ওপর গত বছর আমার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। যুদ্ধ করবো যে, কার জন্য করবো বলো! এখানের মানুষেরা জোর করে চিকিৎসা করতে ডাক্তার নিয়ে এলো। অবাক ব্যাপার কি জানো, কায়সার-ফুল তহবিল থেকে আমার চিকিৎসা হয়েছে। তাই আর না করিনি।
আমার আর খুব বেশি দিন বাকি নেই কায়সার । আমি জানি না জীবনের কোন সীমাবদ্ধতায় আছো তুমি। তবুও, শেষ একবার বলবো, চলে আসো সবকিছু ছেড়েছুড়ে, তোমার ফুলের কাছে। ঝরে যাওয়া এক ফুলের কাছে তুমি সুগন্ধ বা রং আশা কোরো না যেনো! আমাকে দেখলে তোমার হয়তো মানুষ বলেই মনে নাও হতে পারে। আমি জানি না, তুমি আসবে কি না। তবে আশায় থাকবো। আশায় থেকে থেকে একসময় মারা যাবো। আমার সব যন্ত্রণার সমাপ্তি হবে। শেষ কয়েকটা দিন যদি তোমার সাথে কাটাতে পারতাম…
তুমি কি আসবে কায়সার? সবার কাছ থেকে হারিয়ে তোমার ফুলের কাছে আসবে? ছোটবেলায় মা কাঁথা সেলাই করা শেখাতেন। সেলাই করা সহজ ছিলো, তবে সুঁচে সুঁই ভরাটা ছিলো কষ্টের। সেরকম কষ্ট হচ্ছে আমার আজ তোমাকে চিঠিটা লিখতে। কাঁপতে থাকা হাতে আর কতটাই ভালো লেখা যায় বলো? তোমাকে একটা শেষ অনুরোধ করি। জীবনের শেষ অনুরোধ। আমার ডাকে যদি সাড়া দিয়ে তুমি হারাতেই চাও সবার থেকে, তবে সবাইকে জানিয়ে হারাবে। না জানিয়ে না। আমার কাছ থেকে যখন হারিয়েছো, আমাকে অপেক্ষায় ফেলে হারিয়েছো। আর কেউ ‘ফুল’ না হোক।সবাইকে জানিয়ে হারাবে। সবাইকে। দরকার হলে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে হারাবে। তবুও যেনো সবাই জানে।
আসার সময় আমার জন্য একটা গোলাপ আনতে পারবে? ফুলের জন্য ফুল। কত দারুন না ব্যাপারটা?
আর লিখতে পারছিনা আজ। এখানেই থামলাম। বেশি দেরি কোরো না । খরচ করতে করতে করতে… আমার হাতে এখন আর একদম সময় নেই। আর একটা কথা জানার আগ্রহ তোমার পুরো চিঠিজুড়ে থেকে গেছে, জানি। আমি তোমার এত খবর জানলাম কিভাবে? তোমার বন্ধু নাহিদের কাছে জেনেছি। শুরুতে ওকে আমি বিয়ের জন্য দায়ী ভাবতাম। পরে ভুল ভেঙ্গেছে। ওর সৎ মাটা নিজের গায়ে নিজে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। খবর পাওনি হয়তো। নাহিদ বলেছিলো। মানুষের মৃত্যুর খবর নিয়ে আর বেশিকিছু না বলি । আমার জীবন প্রদীপই তো নেভার পথে। দেখো তো খানিকটা আগুন নিয়ে আসতে পারো কি না আমার কাছে। আমি জানি তুমি পারবে। মানুষকে সবার কাছ থেকে হারাতে বলাটা অপরাধ। তবুও বলছি। আমার জীবনের এটাই শেষ সখ, শেষ আহ্লাদ, শেষ আবদার…শেষ ইচ্ছা।
-ইতি
তোমার এবং শুধুমাত্র তোমার ফুল

এরপর কী হলো??

বই: একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি
লেখক: মনদীপ ঘরাই
প্রকাশনী: অন্যপ্রকাশ
বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে ইনবক্স করুন
#মনদীপ_ঘরাই

সংবাদটি শেয়ার করুন ...

এই বিভাগের আরো সংবাদ...
© All rights reserved © ২০২৩ স্মার্ট বরিশাল
EngineerBD-Jowfhowo