সুলতানী আমলের নিদর্শন গজনী দিঘি। বরিশাল সদর উপজেলার চাঁদপুরা ইউনিয়নে অবস্থিত এই দিঘি। প্রতি বছর গজনী মেলা মিলতো এখানে। বাতাস ফকিরের আস্তানায় হাজার হাজার মানুষ আসতো কল্যাণের আশায়। কেউবা দিঘীতে গোসল দিতেন, কেউবা মাছকে দিতেন খাবার। সেই আদিকোল থেকে এখনো পর্যন্ত দিঘীর পানি শুকায়নি। ঐতিহ্যের সেই নিদর্শন এখন বেহাত হওয়ার পথে। দিঘীর পাড় দখলে দীর্ঘদিন একটি মহল ছিল মরিয়া। এবার তারা এটি লিজ নিয়ে সম্পূর্ণ দখলের পায়তারা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, সুলতানী আমলে গজনীর কোনো এক সুলতান বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজনে এই দিঘি খনন করেন। স্থানীয় জাগীরদার বা জমিদারকে এটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেন। যে কারণে এ দিঘিটির নাম গজনীর দিঘি ছিল।
আহঞ্জী বা ইসলাম ধর্মের প্রচারকারী হবার সুবাদে বরিশালের চাঁনপুরা ইউনিয়নের মানুষের কাছে আহঞ্জীদের আদিপিতা ইয়ারউদ্দিন আখনের গ্রহণযোগ্যতা ছিল অনেকটাই জমিদারদের মতো। বিচার আচার, সামাজিক যেকোনো সমস্যার সমাধানে এ অঞ্চলের মানুষেরা এখনো আহঞ্জী (বর্তমান তালুকদার) বাড়ি নির্ভর। যে কারণে গজনীর দিঘিটাও আহঞ্জীদের নিয়ন্ত্রণে দেন তদানিন্ত গজনীর সুলতান।
সুলতানী আমলের নিদর্শন গজনী দিঘি।জনমুখে প্রচলিত আছে, পরবর্তীতে এই গজনীর দিঘির বিশুদ্ধ পানির সুবিধা গ্রহণ করতে এখানে বাতাস ফকির নামের একজন দরবেশ আশ্রয় গ্রহণ করেন। আহঞ্জীরা ওই দরবেশের থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সুব্যবস্থা করে দিলে তাকে ঘিরে এখানে আশে পাশে বসত শুরু হয়। জমে ওঠে ধর্মীয় নানান উৎসব ও মেলা। গজনীর মেলায় নিয়মিত ঘোড়ার দৌড়ের আয়োজন হতো। আর এ কারণেই মেলাটি অনেক দূর পর্যন্ত সুখ্যাতি লাভ করে।
পুকুরের উত্তর পাড়ে একটি গাছ ছিল, যেটির কষ ছিল রক্ত লাল। গাছটিতে কোপ দিলেই রক্ত বের হতো আর তা দেখতে ভিড় করতেন দূর দূরান্তের মানুষ। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা তখনকার আমলে ওই গাছটিকে পূজা শুরু করলে বাতাস ফকির এটি কেটে ফেলার নির্দেশও দিয়েছিলেন। এটা দেশভাগের অনেক পূর্বের কথা।
বাতাস ফকিরের পরামর্শে আহঞ্জীরা গজনীকে দান করে দেন জনগণের কল্যাণে। যা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব চাপে ইউনিয়ন পরিষদের ওপর। স্বাধীনতার পরেও গজনীর মেলা ছিল ওই অঞ্চলের সেরা বিনোদন। সেখানে নিয়মিত ঘৌড় দৌড় হতো। পরবর্তীতে নাসির নামে এক যুবক হত্যার ঘটনায় ওই মেলা বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর গজনী চলে যায় উপজেলা পরিষদের অধীনে। খুবই চমৎকার আর বিশাল এই পুকুরটি পিকনিক স্পট করার কথা উঠেছিল ১৯৮৫ সালে। ১৯৮৯ থেকে ৯২ সময়ে স্থানীয় কতিপয় যুবক মনির দর্জিসহ ফ্রেন্ডস সোসাইটি এবং ২০১৪-১৬ সাল বরিশাল পূর্বাঞ্চল ছাত্রপরিষদ নামে একটি সংগঠনের মাধ্যমে গজনীকে বাঁচাও আন্দোলন শুরু করে। চমৎকার ও বিশাল নলি পানির পুকুরটির সঙ্গে রামসাগর ও দূর্গা সাগরের তুলনা চলে।
বর্তমানে পুকুরের দক্ষিণ পাড় পুরোটাই দখল করে গড়ে উঠেছে বসতভিটা। পূর্বপাড়ও অনেকটা বেদখল। আজ থেকে প্রায় ২৫০ বছর আগে এই গজনীর দিঘি ছিল আহঞ্জীদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। আহঞ্জী বাড়ির লোকেরা ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা কীভাবে এই পাড় বিক্রী করছে তা কারো বোধগম্য নয়।
সুলতানী আমলের নিদর্শন গজনী দিঘি।বরিশাল পূর্বাঞ্চলীয় উন্নয়ন পরিষদের আহবায়ক ও জেলা পরিষদ সাবেক সদস্য মুনাওয়ারুল ইসলাম অলি এ বিষয়ে বলেন, গজনী দিঘি বরিশালের তথা দেশের একটি ঐতিহ্য। আমরা দীর্ঘদিন যাবত এটি পর্যটন কর্পোরেশনের আওতায় নিয়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সংস্কার ও ঐতিহ্য রক্ষার দাবী জানি আসছি। যেকোনো মূল্যে এটি বেহাত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। আমরা পূর্বাঞ্চলবাসী এটি রক্ষা প্রয়োজনে যেকোনো কর্মসূচী গ্রহণ করবো।
চাদপুরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি ফারুক আলম খান লিটন বলেন, গোপনে গজনী দিঘি লিজ দেয়ার পাঁয়তারা চলছে। দেশের এমন একটি ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন এভাবে নষ্ট হতে দেয়া ঠিক নয়। বরিশাল সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মেহেদী হাসান বলেন, আমরা এটিকে বেদখলমুক্ত করছি। পরে লিজ দেয়া যায় কিনা সেটা দেখা হবে। তবে এখনই আমরা এটি লিজ দিচ্ছি না।