দেখতে কেমন ছিল ছেলেবেলার বরিশাল,নাজিরমহল্লা থেকে দক্ষিণে সদর রোড বরাবর যতদূর চোখ যায় সকালে ১০/১২ জন * বিকালে ১০/১২ জন পথচারীর মাথা দেখতে পেতাম তখন সবাই সাধারণত হেঁটে চলাচল করত বিশেষ প্রয়োজনে ব্যবহার করা হত ঘোড়ার গাড়ি, জমিদারদের যাতায়াতের বাহনও ছিল এই ঘোড়ার গাড়ি। আমি তো চোখে ভালো দেখতে পাই না। এখন একই নাজির মহল্লার সামনে দাঁড়ালে শুধু দেখতে পাওয়া যায় সামনে পিছনে কেবল জনস্রোত। প্রতি মুহূর্তে এখানে দুই দিক থেকে অতিক্রম করছে কেবল মানুষ ও রিক্সার সারি মাঝে মাঝে জীপ ও মোটর গাড়ি ছেলেবেলার দেখা বরিশাল শহর সম্পর্কে বলতে গিয়ে একথা বলেন অগ্নিযুগের বিপ্লবী দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ। গত ২২ এপ্রিল তিনি ১০৩ বছর বয়সে পা দিয়েছেন ১৮৯০ সালের ২২ এপ্রিল বরিশালের কাউনিয়া ক্লাব রোডে পৈত্রিক বাড়িতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম নিবারন চন্দ্র ঘোষ। মায়ের নাম রাজলক্ষ্মী ঘোষ। অগ্নিযুগের বিপ্লবী দেবেন ঘোষ একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় রাজনীতিক চলতি আগস্টের পাঁচ তারিখ বরিশালের জনাকীর্ণ সদর রোডের হ্যানিম্যন হোমিও ফার্মেসিতে তার সঙ্গে কথা বলছিলাম। সঙ্গে ছিলেন তার ভাইপো সুশান্ত ঘোষ এবং সাংবাদিক সুধীর সেন। দেবেন ঘোষ এর বর্ণনায় সেকালের বরিশাল , চলতি শতকের প্রথম দশকের কথা। শহরে তখন লোকসংখ্যা অনূর্ধ্ব ১৫ হাজার। তাদের শতকরা ৯০ জনই ছিলেন হিন্দু। বাকিরা মুসলমান সামান্য কিছু খৃস্টান। আজ এই শহরে লোকসংখ্যা হবে প্রায় তিন লক্ষ । অধিকাংশই মুসলমান। বরিশাল শহরে সেকালে হিন্দুদের জন্য একটি মাত্র বইয়ের দোকান ছিল। নাম ন্যাশনাল লাইব্রেরী। চকবাজারে সেবা- লাইব্রেরী মদন মোহন আখরার পাশে অবস্থিত ছিল এই বইয়ের দোকানের মালিক ছিলেন বিএম কলেজের স্বনামধন্য প্রিন্সিপাল কালীপ্রসন্ন ঘোষ। তার নামেই পরে ব্রজমোহন কলেজের পাঠাগার ভবনের নামকরণ হয়। বইয়ের দোকানে তিনি নিজে বড় একটা বসতেন না। বড় ছেলে সুরেশ ঘোষ দোকান চালাতেন। সেখানে পাঠ্য বই ও হিন্দদের ধর্ম গ্রহ্ন বিক্রি হত, আজ সেখানে কাপড়ের দোকান নাম “স্বদেশী বস্ত্রালয়”। আর চকবাজার পুলের উত্তর পাশে একটি মুসলমানদের বইয়ের দোকান ছিল। এখানে কেবল ধর্মীয় কিতাব পাওয়া যেত।শহরের একমাত্র মসজিদ ছিল ফকির বাড়িতে। আর এই মসজিদ এখন প্রায় ১৫০ বছরের পুরাতন।
সেকালে বরিশাল শহরে রাস্তার রাতে লোহার পোস্টের উপর কেরোসিনের বাতি জ্বলত। পৌরসভার লোক মই দিয়ে পোস্টের উপর কেরোসিনের বাতি জ্বালাত । পৌরসভার লোক মই নিয়ে এসে প্রতিদিন সন্ধ্যায় এই বাতি জ্বালাত এবং সকালে নিভিয়ে যেত। তখনো সিনেমার প্রচলন হয়নি কেবল পুরাতন কয়লা ঘাটে একটি স্থায়ী থিয়েটার মঞ্চ ছিল। ছোটদের তো থিয়েটার দেখার কোন অনুমতিই ছিল না।। ইস্কুলের এমন কি কলেজের ছাত্ররাও থিয়েটার দেখতে পারত না। বরিশাল থিয়েটারে অভিনয়ে অগ্রনী ভূমিকায় ছিলেন অম্বিকা বসু। নিজে গান-বাজনা করতেন। সেকালে নারী চরিত্রে পুরুষরাই অভিনয় করতেন। ছেলে- বেলায় আমি কখনও থিয়েটার দেখার সুযোগ পাইনি।
শহরে তখন পৌরসভার গরুর গাড়িতে ছোট ছোট জলের ট্যাংক বহন করা হত। এ জল বিক্রি হত পানীয় জল হিসাবে। এক পয়সায় কত কলস বিক্রি হত তা এখন মনে নেই। ১৯১২ সালে ওয়াটার ওয়ার্কস চালু হয়। এছাড়া পানিয় জলের জন্য কালেক্টরেট পুকুর রিজার্ভ ছিল। কেউ হাত ও ধুতে পারত না । । টেন্ডুপাতার বিড়ির তখন প্রচলন হয়নি। তামাক হকার প্রচলন ছিল আজকাল তো তা উঠে গেছে। সেকালে কেউ কেউ তামাক পাতার চুরুট খেতেন।
লাল ইটের সুরকির পথ ছিল এই শহরের প্রধান বৈশিষ্ট্য। কীর্তনখোলা নদীর পশ্চিম তীর বরাবর বান্দ রোড ছিল দেখার মত। পরিচ্ছন্ন মনোরম এই রাস্তার পাশে ছিল সারিবদ্ধ পাম ও ধাউগাছ । ষ্টীমার ঘাটটিকে তো মনে হত সুন্দর মনোরম একটি পার্ক। ফুলের বাগানে সাজানো ছিল। সন্ধ্যা হলেই বাতি জ্বলে উঠত। স্টীমার ঘাট থেকে কীর্তনখোলা নদী বরাবর বান্দ রোড ছিল পথচারী সকলের একটি বড় আকর্ষণ। নদীর পারে তখন কোন ঘরবাড়ি ছিল না। যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল নদীর দৃশ্য । আজ সেই বান্দ রোড আর স্টিমার ঘাট দেখে মনে হয় যেন দুঃস্বপ্নের প্রতিচ্ছবি। সেকালে বরিশাল থেকে ঢাকা এবং খুলনার নৌপথে দৈনিক যাতায়াত করত পৃথক এক্সপ্রেস ও মেল স্টিমার। খুলনার পথে কলকাতার যাত্রীরা যাতায়াত করতেন। সুতরাং এই পথে স্টিমারে ভিড় হত বেশি। এছাড়া মাদারিপুর ভায়া গৌরনদী), গোয়ালন্দ, বানারিপাড়া, ভোলা, পিরোজপুর (হুলারহাট), পটুয়াখালি ও আসামের পথে স্টিমার চলাচল করত।
১৯১৫-১৬ সালের দিকে বরিশালে প্রথম মোটর গাড়ি আসে, বাসন্ডার জমিদার যোগেন সেনের মোটর গাড়ির কথা মনে আছে।১৯২১-২২ সালে চালু হয় হাতে টানা রিকশা, যা এখন কেবল কলকাতায় আছে। কিন্তু ঘোড়ার গাড়িকে কেউ টেক্কা দিতে পারেনি।শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে যেত অনেক খাল । এসব খালে জোয়ার-ভাটা ছিল নৌকা চলত। সম্ভবত পরে এ কারণে কাজী নজরুল ইসলাম বরিশালকে বাংলার ভেনিস” বলেছিলেন। শহরের অধিকাংশ ঘর ছিল টিনের ও গোলপাতার তৈরি । হাতে গোনা কয়েকটি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের দালান ছিল। আমাদের বাড়িটিও ছিল একতলা দালান। হিন্দু জমিদারদের বাইরে সায়েস্তাবাদের নওয়াব (কবি সুফিয়া কামালের মাতুলালয়) ওজমিদার ইসমাইল চৌধুরীর বাড়ি আজো দৃষ্টি কাড়ে। জমিদার স্বরূপ চন্দ্র গুহর বাড়িতে এখন আইন কলেজ। আর অশ্বিনী ভবনে প্রতিষ্ঠা হয়েছে বরিশাল কলেজ।
তখন শহরের একমাত্র বাজার ছিল আজকের পুরান বাজার। এছাড়া সাপ্তাহিক হাট বসত। কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে পদ্মাবতী লেনে এই হাট ছিল। নদীর ভাঙ্গনে এ হাট। সরে গেছে উত্তরে আজকের যায়গায়। বাজারে জিনিসপত্রের দাম ছিল বালাম চাল প্রতিমন দুই টাকা। ইলিশ মাছ টাকায় ২০টি। এক কুড়ি বড় কৈ মাছ, পাওয়া যেত ৮ আনায়। একখানা ধৃতির দাম ১২ আনা। চৈত্র মাসে প্রতিসের দুধের দাম ছিল এক পয়সা। শীতকালে দুধের দাম বাড়তো। সেকালে ঘরে ঘরে গাই গরু পালা হত। তাই দুধের কোন কোমতি ছিল না।এক আনায় ছানার এক সের রসগোল্লা। আদালতের পাশে বিহারী ঘর বরণ মিষ্টির দোকান খোলেন ১৯১০ কিংবা ১৯১২ সালে। দুই আনা ছিল চিনির সের।এক দিস্তা সাদা ভালো ফুল স্ক্রিপ কাগজের দাম ছিল ছয় পয়সা।ব্রাউন কাগজের দিস্তা ছিল এক আনা।
নিজের প্রসঙ্গে শতায়ু অগ্নিযুগের বিপ্লবী নেতা দেবেন ঘোষ বলেন ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের শুরু তখন নিয়মিত মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের কাছে যেতাম। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আমি তাকে ‘দাদু বলে ডাকতাম। তখন বিএম স্কুলে নীচের ক্লাসে পড়ি। শহরে বসবাস করে অথচ খেতে পায় না এমন গরীব লোকের তালিকা সংগ্রহ করে এনে দাদূর হাতে দিতাম। কলেরার আক্রান্ত হয়ে যারা মারা যেত তাদের সৎকার অংশ নিতাম এ কাজে আমাদের সাথে থাকতেন কলেজ ছাত্র প্রফুল্ল চ্যাটার্জি। তাকেও দাদু অনেক আদর করতেন কিন্তু নিজের ভাইপো সজল দত্ত এবং কীর্তি পাশার জমিদার পুত্র অম্বিকা রায় চৌধুরী এবং মাহিলারার জমিদার পুত্র নরেন সেন কে চোখে চোখে রাখতেন তারা সবাই ছিল বিএম কলেজের ছাত্র। আমি কখনো দাদুর কাছে কিছু চাইলে তা তিনি বুঝে ফেলতেন তিনি বলতেন “দুষ্টু গুলো’ পাঠিয়েছে তখন আর তা দিতেন না।
( “সুশান্ত ঘোষের “দা এর পোস্ট থেকে সংগৃহীত)